আমরা কি এক কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে বাস করছি?
রাতের আকাশে ঝিকিমিকি তারার দিকে তাকিয়ে কি মনে হয় এই মহাকাশ বোধহয় অসীম, অনন্ত? কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্য কথা। তারা বলছেন, এই মহাবিশ্বেরও একটি সীমানা আছে।
প্রথমত, বিজ্ঞানীদের ধারণা, স্থান এবং কালের শুরু হয়েছিল একটি বিন্দু থেকে। পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র সেই বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। প্রচণ্ড তাপ আর ঘনত্বের সেই বিন্দু এক মহাবিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) পর বেলুনের মতো ফুলতে শুরু করে। দ্বিতীয়ত, আমরা মহাবিশ্বের যতোটুকু দেখতে পাই, তার একটি নির্দিষ্ট সীমানা রয়েছে, যার নাম 'ইভেন্ট হরাইজন' বা ঘটনা দিগন্ত। এর বাইরের কিছু আমরা দেখতে পাই না, কারণ মহাবিশ্ব আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে, বহু নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি আমাদের দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে গেছে।
মজার ব্যাপার হলো, সিঙ্গুলারিটি এবং ইভেন্ট হরাইজন—এই দুটি বৈশিষ্ট্যই হুবহু মিলে যায় আরেক মহাজাগতিক বিস্ময়, কৃষ্ণগহ্বরের সাথে। মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো এই মহাকর্ষীয় দানবরা গ্যাস, ধুলো আর আলো গিলে খায়। মহাবিশ্বের মতোই, কৃষ্ণগহ্বরেরও একটি নিজস্ব ইভেন্ট হরাইজন আছে—এমন এক অদৃশ্য দেয়াল, যার ওপার থেকে কোনো কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না। আর এই মিল দেখেই বিজ্ঞানীরা এক অবাক করা প্রশ্ন তুলেছেন—তবে কি আমাদের এই বিশাল মহাবিশ্বটাই একটা কৃষ্ণগহ্বরের পেটের ভেতর রয়েছে?
অবশ্যই, এই ধারণাটা আর দশটা আটপৌরে মহাকাশ তত্ত্বের মতো নয়। তবে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে বাস করার এই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভাবনাটি এখন আর কেবল কল্পনাবিলাসীদের আড্ডার বিষয় নয়। কানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউট ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের জ্যোতির্পদার্থবিদ নায়েশ আফশোরদি বলেন, "এটি অবশ্যই একটি যৌক্তিক ধারণা। আসল চ্যালেঞ্জ হলো, এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে বাস্তবে মিলিয়ে দেখানো।"
মহাবিশ্ব যখন কৃষ্ণগহ্বর
মহাবিশ্ব আর কৃষ্ণগহ্বর—দুইয়ের চরিত্র বোঝার গাণিতিক সূত্রগুলো যেন একই সুতোয় গাঁথা। দুটোর ধারণাই এসেছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে। কাকতালীয়ভাবে, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের যে ব্যাসার্ধ, ঠিক একই আকারের একটি কৃষ্ণগহ্বরের যা ভর থাকার কথা, আমাদের মহাবিশ্বের ভরও ঠিক ততটাই।
এই মিলগুলো দেখেই বিভিন্ন সময়ে গবেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা কি তাহলে একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেই আছি? ১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানী রাজ কুমার পাঠরিয়া এবং আই. জে. গুড প্রথম এই তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন।
প্রায় ২০ বছর পর, পদার্থবিদ লি স্মোলিন এই ধারণাটিকে যেন কল্পবিজ্ঞানের প্লট বানিয়ে দিলেন। তার মতে, আমাদের মহাবিশ্বে যখনই কোনো কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম হয়, তার ভেতরেই একটি নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হয়, যার পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুন আমাদের থেকে কিছুটা আলাদা। অর্থাৎ, এক মহাবিশ্বের গর্ভে জন্ম নিচ্ছে আরেক শিশু মহাবিশ্ব! তিনি এর নাম দেন 'মহাজাগতিক প্রাকৃতিক নির্বাচন'।
আয়নার দুই পিঠ
তবে অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর চোখে, মহাবিশ্ব আর কৃষ্ণগহ্বর যেন একে অপরের আয়নার প্রতিচ্ছবি, দুটোই যেন দুই মেরুর বাসিন্দা।
আমাদের মহাবিশ্বের পথচলা শুরু হয়েছিল একটি সিঙ্গুলারিটি বা অসীম ঘনত্বের বিন্দু থেকে, যা মহাবিস্ফোরণের পর প্রসারিত হতে শুরু করে। অন্যদিকে, একটি কৃষ্ণগহ্বরের যাত্রা শেষ হয় সিঙ্গুলারিটিতে গিয়ে—যেখানে সবকিছু মহাকর্ষের টানে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হয়।
কৃষ্ণগহ্বরের ইভেন্ট হরাইজন হলো একমুখী পথ। পপ কালচারে কৃষ্ণগহ্বরকে মহাজাগতিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার মনে হলেও, বাস্তবে এগুলো বেশ শান্ত। একটি মহাকাশযান চাইলেই এর চারপাশে নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে। কিন্তু একবার যদি তা ইভেন্ট হরাইজনের সীমানা পেরিয়ে যায়, তাহলে আর ফেরার পথ নেই।
আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণও অনেকটা এমনই এক ঘটনা ঘটাচ্ছে। টেলিস্কোপে তাকালে দেখা যায়, দূরের গ্যালাক্সিগুলো আমাদের কাছ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর এই গতি আলোর চেয়েও বেশি হয়ে যায়। ফলে সেই নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিগুলো আমাদের মহাজাগতিক দিগন্তের ওপারে চিরতরে হারিয়ে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এমন, যেন গ্যালাক্সিগুলো এক উল্টো কৃষ্ণগহ্বরের গহ্বরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার, তাই না? তবে বিজ্ঞানীদের কাছে মূল কথা হলো, এই বাহ্যিক মিলগুলোর মানেই এই নয় যে একটির ভেতরে আরেকটি আছে। এমন দাবি করতে হলে চাই হাতে-নাতে প্রমাণ।
ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ অ্যালেক্স লুপসাস্কা বলেন, "আমাদের কাছে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে এবং সেগুলোর সম্ভাব্য ফলাফলও আছে। যদি কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে সেই ফলাফল ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে বুঝতে হবে তত্ত্বের মূল ধারণাটাই ভুল ছিল।"
প্রমাণ মিলবে কীভাবে?
যদি আমরা সত্যিই একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে থাকতাম, তাহলে কী দেখা যেত? প্রথমত, মহাবিশ্বের হয়তো একটি নির্দিষ্ট দিক বা পক্ষপাত থাকত। যেমন, বেশিরভাগ গ্যালাক্সি একটি নির্দিষ্ট দিকে ঘুরছে, অথবা মহাবিস্ফোরণের পর যে তাপীয় বিকিরণ টিকে আছে, তার মধ্যে একটা বিশেষ অক্ষ থাকত। আফশোরদি বলেন, "এমনটা হলে মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কিছুটা পার্থক্য দেখা যেত। এক দিক হয়তো কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের দিকে ইঙ্গিত করত, আর অন্য দিকটা বাইরের দিকে।"
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি ঠিক তার উল্টোটা। বিশাল পরিসরে আমাদের মহাবিশ্ব সব দিকেই প্রায় একই রকম, সুশৃঙ্খল আর গোছানো। বিজ্ঞানীরা একে বলেন 'মহাজাগতিক নীতি'। একটি মৃত নক্ষত্রের বিশৃঙ্খল ও অগোছালো বিস্ফোরণ থেকে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কীভাবে এমন সুষম একটি মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে, তা এই তত্ত্বের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
আরেকটি বড় বাধা হলো সিঙ্গুলারিটির ধারণা। এটি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের সবকিছুর অবশ্যম্ভাবী শেষ পরিণতি, যা আমাদের ক্রমপ্রসারমাণ মহাবিশ্বের ধারণার ঠিক বিপরীত।
এইসব রহস্যের জট খুলতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের দুটি মহীরুহকে এক করতে হবে—বড় বস্তুদের জন্য আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আর ক্ষুদ্র কণার দুনিয়ার জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স। সিঙ্গুলারিটি হলো বিশাল ভরের এক অতিক্ষুদ্র বিন্দু, তাই এর রহস্য ভেদ করতে হলে এই দুই তত্ত্বকে এক সুতোয় বাঁধতে হবে। বহু চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা এখনো সেই 'কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি' তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারেননি। আর একারণেই আমরা জানি না কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কিংবা মহাবিস্ফোরণের ঠিক আগে কী ঘটে।
তা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই অদ্ভুত ধারণাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করাটা বেশ মজার এবং এর পথ ধরেই হয়তো নতুন কোনো আবিষ্কারের দুয়ার খুলে যেতে পারে। কে জানে, হয়তো এই অদ্ভুত ভাবনার পথ ধরেই একদিন বেরিয়ে আসবে মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় কোনো রহস্যের সমাধান।
