ট্রাম্পের সাথে বৈঠক: পুতিনের বিমান কি ইউরোপের আকাশসীমা পেরিয়ে বুদাপেস্টে পৌঁছাতে পারবে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বুদাপেস্টে যাবেন কি না, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এই সফর সত্যি হলে তাকে কয়েকটি বড় বাধা পেরোতে হবে।
গত আগস্টে পুতিন যখন অ্যাঙ্কোরেজ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য আলাস্কায় গিয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রেসিডেন্সিয়াল বিমানকে বিশেষ অনুমতি দিয়েছিল। পুতিনের এই পরিবর্তিত ইলিউশিন ইল-৯৬ বিমানটি চারটি ইঞ্জিনযুক্ত এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সুসজ্জিত, যা 'ফ্লাইং ক্রেমলিন' নামে পরিচিত।
বর্তমানে রাশিয়ার বিমান যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আকাশসীমায় নিষিদ্ধ। সুতরাং, পুতিনকে বুদাপেস্টে যেতে হলে ইইউ সদস্যভুক্ত কোনো দেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হবে।
স্থলবেষ্টিত দেশ হাঙ্গেরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের জন্য সহজ গন্তব্য নয়। পুতিন দীর্ঘদিন ধরে ইইউভুক্ত কোনো দেশে যাননি। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, 'এখনও কিছু নিশ্চিত নয়। তবে দুই প্রেসিডেন্টই বৈঠক করতে আগ্রহী।'
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পুরোদমে রুশ আগ্রাসন শুরুর কয়েকদিন পরই ইইউ পুতিন এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সম্পদ জব্দ করে। একই সঙ্গে ২৭টি ইইউ দেশের আকাশসীমা দিয়ে রাশিয়ার সব ধরনের বিমানের চলাচলের ওপর সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
হাঙ্গেরি ও তার প্রতিবেশী অনেক দেশ ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল।
এর ওপর পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইউক্রেনীয় শিশুদের অবৈধভাবে রাশিয়ায় স্থানান্তরের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তবে হাঙ্গেরি বলছে, এসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, কেননা দেশটি আইসিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
ইইউতে পুতিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান এরই মধ্যে প্রস্তাবিত শীর্ষ বৈঠক নিয়ে পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজিয়ার্তো সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করব যে তিনি হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে পারেন, এখানে সফল আলোচনা করতে পারেন এবং তারপর দেশে ফিরে যেতে পারেন।'
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান
ইইউও বাধা দেওয়ার সম্ভাবনা কম। কমিশন জানিয়েছে, ইউক্রেনে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় যেকোনো বৈঠককে তারা স্বাগত জানায় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে। কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, পুতিনের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নেই—শুধু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
শুক্রবার ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র আনিতা হিপার বলেছেন, 'ভ্রমণের দিক থেকে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড় দিতে পারে, তবে তা অবশ্যই প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে পৃথকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'
আকাশপথের জটিলতা ও সম্ভাব্য রুট
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মস্কো থেকে বুদাপেস্টে কীভাবে যাবেন। তিনি নিশ্চয়ই এয়ার সার্বিয়ার টিকিট কিনে বেলগ্রেড গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে হাঙ্গেরি যাবেন না, যদিও এটিই হতে পারে সবচেয়ে সরাসরি পথ।
নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি নিজস্ব 'ইল-৯৬' বিমানে যাত্রা করবেন। এর অর্থ হলো, তাকে কোনো ইইউ ও ন্যাটোভুক্ত দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে হবে এবং রাশিয়ার বিমানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে অনুমতি নিতে হবে। যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় ট্রাম্প জড়িত, তাই দেশগুলো হয়তো সম্মতি দিতে পারে।
মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, পুতিনকে একটি ঘুরপথ নিতে হতে পারে। ইউক্রেনের আকাশপথ ব্যবহার অসম্ভব, এবং মস্কোর সঙ্গে শীতল সম্পর্কের কারণে পোল্যান্ডও বাদ পড়বে।
সম্ভাব্য রুট হতে পারে কৃষ্ণসাগরের পূর্ব উপকূল ধরে তুরস্ক, তারপর বুলগেরিয়া হয়ে সার্বিয়া বা রোমানিয়ার মাধ্যমে হাঙ্গেরি। সার্বিয়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং মস্কোর সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চালু রেখেছে, যদিও দেশটি এখনো ইইউ সদস্য নয়।
এক্ষেত্রে ইইউভুক্ত দেশ বুলগেরিয়া বা রোমানিয়াকে সম্মতি দিতে হবে এবং তাদের আকাশসীমার মধ্য দিয়ে পুতিনের বিমানকে এসকর্ট করে নিয়ে যেতে হবে।
পুতিন যদি আরও নিরাপদে ভ্রমণ করতে চান, তাহলে তিনি তুরস্ক হয়ে গ্রিসের দক্ষিণ উপকূল ঘুরে মন্টিনিগ্রোর আকাশসীমা দিয়ে সার্বিয়ার ওপর দিয়ে যেতে পারেন। তবে এটি অনেক দীর্ঘ একটি পথ।
অরবানের রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ
ভিক্টর অরবানের জন্য বুদাপেস্ট এই বৈঠকের জন্য একটি আদর্শ স্থান, কারণ পুতিন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প—উভয়ের সঙ্গেই তার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক রয়েছে।
শুক্রবার ট্রাম্প অরবান সম্পর্কে বলেন, 'তিনি এমন একজন নেতা যাকে আমরা পছন্দ করি, তিনি তাকে [পুতিনকে] পছন্দ করেন, আমিও তাকে পছন্দ করি।'
আগামী বসন্তের নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে অরবান কিছুটা পিছিয়ে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে একটি হাই-প্রোফাইল আন্তর্জাতিক সম্মেলন তার ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক হবে।
বুদাপেস্টকে বৈঠকের স্থান হিসেবে ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অরবান পুতিনকে ফোন করেন এবং নিজের ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেন: 'প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে!'
অরবান স্পষ্ট করেছেন, এই বৈঠকে ইইউর কোনো ভূমিকা থাকবে না। তিনি বলেন, 'ইইউ যেহেতু ইউক্রেনের যুদ্ধকে সমর্থন করে, তাই এই শান্তি প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাদ পড়াই স্বাভাবিক।'
তবে আগামী সপ্তাহে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপীয় নেতারা যখন তার সঙ্গে দেখা করবেন, তখন তাদের ভাবনা ভিন্ন হতে পারে।