স্মার্টফোনের নীল আলো চাঁদের পর্যায় ও মাসিক চক্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে: গবেষণা
প্রায় ৪৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর সৃষ্টি, আর তার মাত্র ১০ কোটি বছর পরই জন্ম নেয় চাঁদ। সেই থেকেই পৃথিবীর উপগ্রহটি আমাদের গ্রহে জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে এবং জীবজগতের ওপরও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁদের পর্যায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক মাছ, প্রবাল ও সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী তাদের ডিম পাড়ে, যাতে নির্ধারিত সময়ে প্রজনন ঘটে এবং টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।
এই সমন্বয় ব্যাজারসহ ভেনেজুয়েলা ও জাপানের কিছু প্রজাতির গরুতেও দেখা গেছে।
নতুন চাঁদের সময় ম্যাকাক বানরের প্রজননক্ষমতা বেশি থাকে। ধারণা করা হয়, অন্ধকারের কারণে তারা তখন শিকারিদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকে।
অপরদিকে পাহাড়ি গরিলাদের, যাদের প্রাকৃতিক শত্রু প্রায় নেই, মধ্যেও পূর্ণিমার সঙ্গে প্রজননের এই সমন্বয় দেখা দেয়।
চাঁদের সঙ্গে নারীদের মাসিক চক্রের সম্পর্ক নিয়ে বহুদিন ধরেই গবেষণা চলছে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ও স্ক্রিনের নীল আলো চাঁদের পর্যায় ও নারীদের মাসিক চক্রের মধ্যকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।
চাঁদের চক্র (এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রায় ২৯.৫ দিন) ও নারীদের মাসিক চক্রের (গড়ে ২৬ থেকে ৩২ দিন) মিল দেখে অনেকেই মনে করেন চাঁদ নারীদের ডিম্বস্ফোটনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ পায়নি।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সায়েন্স অ্যাডভান্সেস পত্রিকার এক গবেষণায় চাঁদের প্রভাবের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এবং কেন সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে এই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেটিরও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব উইরৎসবার্গের স্নায়ুবিজ্ঞানী শার্লট হেলফরিখ-ফোর্স্টারের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় গত ৭০ বছরের ১৭৬ জন নারীর ১১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মাসিক রেকর্ড বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের গবেষণাগুলোতেও ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, যেসব নারীর মাসিক চক্র গড়ে ২৯.৫ দিনের কাছাকাছি, নতুন চাঁদ বা পূর্ণিমার সময় তাদের মাসিক শুরু হতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ভারসাম্য দেখা যায়নি।
হেলফরিখ-ফোর্স্টার ধারণা করেন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণেই হয়তো এই পরিবর্তন ঘটেছে।
তিনি বলেন, 'আমি ২০১০ সালের আগে ও পরের তথ্য আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা, তখনই বাজারে আসে এলইডি বাতি, যা প্রচলিত বাল্বের জায়গা নেয়, এবং মানুষ ক্রমে বেশি করে স্ক্রিন ব্যবহার করতে শুরু করে। এসব স্ক্রিন থেকে নীল আলো নির্গত হয়। এই আলো মানুষের জৈব ঘড়ি বা হরমোনের ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে।'
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০১০ সালের আগে অনেক নারীর মাসিক চক্র পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সঙ্গে মিলে যেত, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উভয় স্তরে। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে সেই সমন্বয় প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। তবুও জানুয়ারি মাসে, যখন পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে এবং সূর্য ও চাঁদের মহাকর্ষীয় প্রভাব একসঙ্গে কাজ করে, তখন কিছুটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এই গবেষক স্বীকার করেছেন, এই মহাকর্ষীয় প্রভাব ব্যাখ্যা করা কঠিন।
তিনি বলেন, 'পৃথিবীর ওপর চাঁদের শক্তিশালী মহাকর্ষীয় প্রভাব রয়েছে, যা আমরা জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে দেখি। তবে মানুষ কীভাবে এই প্রভাব অনুভব করে, তা আমরা জানি না।'
স্পেনে ইউনিভার্সিটি অব মুরসিয়ার ক্রোনোবায়োলজি অ্যান্ড স্লিপ ল্যাবরেটরির পরিচালক মারিয়া দে লস আঞ্জেলেস রোল দে লামা [তিনি এই গবেষণায় অংশ নেননি] বলেন, 'গবেষণাটি মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও এটি এতদিনকার প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার সঙ্গে কিছুটা বিরোধপূর্ণ।'
তিনি আরও বলেন, 'চাঁদের প্রভাব নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা কঠিন, কারণ স্বাভাবিক জীবনযাপনের নানা বিষয় মাসিক চক্রে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের গবেষণা সঠিকভাবে করতে হলে অন্তত এক মাস নারীদেরকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে,যেমন একটি বাঙ্কারে রাখতে হবে।'
এর আগেও এমন গবেষণা হয়েছে, যদিও এই ধরনের পরীক্ষা পুনরায় করা বেশ কঠিন।
১৯৬২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী মিশেল সিফ্রে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ঘড়ি বা প্রাকৃতিক আলো ছাড়া কয়েক মাস ধরে একটি গুহায় একাকী ছিলেন। তার এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে, মানুষের শরীরে প্রায় ২৪ ঘণ্টার মতো একটি অভ্যন্তরীণ ছন্দ বা জৈব ঘড়ি কাজ করে, তবে সেটি সূর্যের দিন-রাতের সময়ের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এ পরীক্ষাই প্রথমবার মানুষের অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়ির অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
বিজ্ঞানী ক্লোদ গ্রঁফিয়ে গত বছর এক প্রবন্ধে দাবি করেছিলেন যে মাসিক চক্র মূলত দেহের অভ্যন্তরীণ জৈব ঘড়ি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং চাঁদের প্রভাব ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তিনি নতুন এই গবেষণা ও সাম্প্রতিক অনুরূপ গবেষণাগুলো দেখে মত দিয়েছেন যে চাঁদ ও মাসিক চক্রের সম্পর্ক 'স্রেফ কাকতালীয় নয়'।
তবে স্মার্টফোন ও এলইডি আলোর কারণে মাসিক চক্র ও চাঁদের পর্যায়ের মধ্যকার সমন্বয় হারিয়ে গেছে—এই ধারণা সম্পর্কে তিনি মনে করেন, 'গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীরা কী ধরনের আলোয় ছিলেন, সেটির সুনির্দিষ্ট রেকর্ড থাকলে এই অনুমান যাচাই করা যেত। এতে বোঝা যেত, ২০১০ সালের আগে ও পরে অংশগ্রহণকারীদের পরিবেশে আলোর তীব্রতা আসলেই পরিবর্তিত হয়েছিল কিনা।'
গ্রঁফিয়ে সতর্ক করে বলেন, গত ১৫ বছরে এই সম্পর্ক দুর্বল হওয়ার পেছনে কেবল আলো নয়, অন্যান্য পরিবেশগত কারণও থাকতে পারে। যেমন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। এছাড়া ব্যক্তিগত কারণও (যেমন বয়স বৃদ্ধি, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি) ভূমিকা রাখতে পারে।
তাই তিনি সতর্ক করে বলেন, তুলনামূলকভাবে অল্প সংখ্যক নারীর ওপর ভিত্তি করে পাওয়া ফলাফল ব্যাখ্যা করার সময় সাবধান থাকা প্রয়োজন।
চাঁদের সঙ্গে নারীদের মাসিক চক্রের সম্পর্কের রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি, যেমনভাবে মানুষের জীবনে চাঁদের সম্ভাব্য অন্যান্য প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। মানসিক চাপ, হরমোন পরিবর্তন, কঠোর ডায়েট বা স্থূলতার কারণে মাসিক চক্রের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হতে পারে। আবার, মাসিক চক্রের গড় সময় চাঁদের চক্রের কাছাকাছি হলেও পুরোপুরি সমান নয়, ফলে অনেক সময় কাকতালীয় মিলকেও বাস্তব সমন্বয় হিসেবে ধরা হয়।
এ ছাড়া, অনেক গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীরা নিজেরাই তথ্য লিপিবদ্ধ করেন, যা নির্ভুল নাও হতে পারে; নমুনার সংখ্যা কম হওয়ায় বিশ্লেষণ করাও জটিল হয়ে পড়ে। ফলে নারীরা একসঙ্গে থাকলে তাদের মাসিক সময় এক হয় কি না, কিংবা চাঁদ আসলেই কোনো প্রভাব ফেলে কি না এসব বিষয়ে গবেষণার ফল অনেক সময় অস্পষ্ট, দুর্বল এবং পুনরায় প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তাই এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা চাঁদের প্রভাব নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
