স্থবির স্মার্টফোন বাজার, পুরনো উন্মাদনা ফেরাতে অ্যাপলের নতুন কৌশল এবার ‘আইফোন এয়ার’

গ্রাহকদের মুগ্ধ করতে এখন আর শুধু উন্নত ক্যামেরা, বড় স্ক্রিন বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি যথেষ্ট নয়, এমনটাই মনে করছে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল। এই উপলব্ধি থেকেই মঙ্গলবার কোম্পানিটি নতুন 'আইফোন এয়ার' ঘোষণা করেছে, যা তাদের ফ্ল্যাগশিপ পণ্যে প্রায় এক দশক পর এক বড় নকশার পরিবর্তন।
মূল উপস্থাপনায় অ্যাপলের এক নির্বাহী বলেন, 'এত পাতলা ও হালকা যে, হাতে নিলে অদৃশ্য মনে হবে।'
স্মার্টফোন বাজারে নতুনত্বের অভাবে বিক্রয় হ্রাসের মুখোমুখি হওয়ার পর, আইফোন এয়ারের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। ২০২৪ সালে আইফোন ১৬-এর উদ্বোধনী সপ্তাহের বিক্রি আগের বছরের তুলনায় কম ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আইফোন এয়ার এবং আইফোন ১৭ লাইনআপের মাধ্যমে অ্যাপলের ওপর নতুন কিছু দেওয়ার চাপ বেড়েছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন একটি আপগ্রেডের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল, যা আইফোন ৬-এর সময় দেখা গিয়েছিল। আইফোন এয়ার অ্যাপলকে সেই 'সুপারসাইকেল' এনে দিতে পারবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে অনেকেই আশাবাদী, নতুন ডিজাইনের আইফোন আগের বছরের পুনরাবৃত্তিমূলক আপডেটের তুলনায় ক্রেতাদের বেশি উৎসাহিত করবে। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই নতুন ডিভাইসটি আইফোনের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করতে পারে।
ধীরগতির বাজার, গ্রাহকদের দীর্ঘ ব্যবহার
স্মার্টফোন বাজার একটি কঠিন সময় পার করার পর বর্তমানে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আইডিসি এর তথ্য অনুযায়ী, ধীর চাহিদার কারণে ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বিক্রয় একক প্রান্তিকে সবচেয়ে বড় পতন দেখেছিল। গ্লোবাল স্মার্টফোন শিপমেন্ট ট্র্যাক করা আরেকটি প্রধান সংস্থা কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চও জানিয়েছে, ২০২৩ সালে স্মার্টফোন বাজার টানা আটটি প্রান্তিকে পতন দেখেছে।
তবে ২০২৫ সালে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। আইডিসি-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিক্রি বছরে ১ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি এবং শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও চাহিদাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
গ্রাহকরা এখন সত্যিই তাদের ডিভাইসগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করছেন। মরগান স্ট্যানলি সম্প্রতি অনুমান করেছে যে, স্মার্টফোন প্রতিস্থাপনের চক্র ৪.৭ বছর, যা ২০২৬ সালে পাঁচ বছরে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভেরিজন-এর সিইও এবং চেয়ারম্যান ২০২৪ সালে সিএনবিসিকে বলেছিলেন যে, গ্রাহকরা তাদের ফোনগুলো "৩৬ মাসেরও বেশি" সময় ধরে রাখছেন, যা তিনি "খুব দীর্ঘ" বলে উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের মনে আছে আমরা প্রতি বছর ফোন পরিবর্তন করতাম। সেটি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ সময়।'
প্রয়োজনে আপগ্রেড, নতুন ফিচারে নয়
কনজিউমার ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ পার্টনারস এর মতে, যখন গ্রাহকরা ফোন আপগ্রেড করেন, তখন তা সাধারণত নতুন ফিচার বা প্রযুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং প্রয়োজনের তাগিদেই হয়ে থাকে। মার্কিন স্মার্টফোন ক্রেতাদের অভ্যাস পর্যবেক্ষণকারী এই সংস্থাটি দেখেছে, ৬৮ শতাংশ আমেরিকান স্মার্টফোন ক্রেতা তাদের ফোন পরিবর্তন করেন কারণ এটি প্রতিস্থাপন করা দরকার, ব্যাটারির কার্যকারিতা কমে গেছে, অথবা স্ক্রিন ফেটে গেছে।
এই বাস্তবতা প্রযুক্তি জায়ান্টদের অজানা নয়। বহু বছর ধরে তারা স্মার্টফোনের প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। স্যামসাং ২০১৯ সালে তাদের প্রথম ফোল্ডেবল ফোন বাজারে আনে এবং জানায় যে, গত জুলাই মাসে চালু হওয়া গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড ও জেড ফ্লিপ-এর সর্বশেষ মডেলের প্রি-অর্ডার আগের মডেলের তুলনায় ২৫% এর বেশি বেড়েছে।
স্যামসাং ছিল প্রথম স্মার্টফোন নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম, যারা ফোল্ডেবল ফোন বাজারে আনে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি প্রধান অ্যান্ড্রয়েড নির্মাতা, মটোরোলা থেকে শুরু করে গুগল এবং অপোর মতো চীনা প্রযুক্তি জায়ান্টরাও একই পথ অনুসরণ করেছে।
ফোল্ডেবল ফোনের সম্ভাবনা ও অ্যাপলের কৌশল
অ্যাপল এখনও ফোল্ডেবল ফোন বাজারে আনেনি। তবে তারা গত এক দশকে ডিজিটাল পরিষেবা এবং পরিধানযোগ্য ডিভাইসের ক্ষেত্র প্রসারিত করে এমন একটি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, যেখানে গ্রাহকরা আর আইফোন কেনার জন্য লাইন ধরছেন না। এই বিভাগগুলো দুর্বল আইফোন বৃদ্ধির সময়ে বিনিয়োগকারীদের সন্তুষ্ট রাখতে কিছুটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে; অ্যাপলের ডিজিটাল পরিষেবা বিভাগ এখন আইফোনের পর তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসা–যদিও সাম্প্রতিক আদালতের কিছু মামলা অ্যাপলের এই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
প্রায় এক দশকের মধ্যে এই প্রথম অ্যাপল এমন একটি আইফোন নিয়ে আসছে যা দেখতে ও অনুভব করতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। আইফোনের বাহ্যিক রূপ প্রতি বছর সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তিত হলেও, ২০১৭ সালে আইফোন এক্স চালু হওয়ার পর থেকে এতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। আইফোন এক্স ছিল হোম বাটনের পরিবর্তে ফেস আইডি এবং বড় স্ক্রিনযুক্ত প্রথম মডেল।
আইফোন এয়ার, আইফোন ১৭ এবং ১৭ প্রো-এর তুলনায় কিছু সীমাবদ্ধতা (যেমন, এতে কেবল একটি ক্যামেরা রয়েছে) থাকা সত্ত্বেও, সেইসব ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে যারা একটি নতুন ধরনের ফোন চান কিন্তু ক্যামেরা আপগ্রেড বা বড় স্ক্রিন নিয়ে ততটা আগ্রহী নন।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যান আইভস মঙ্গলবার একটি গবেষণা নোটে উল্লেখ করেন যে, এই পুনঃনকশা আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে আইফোন আপগ্রেডের বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। তিনি অনুমান করেন যে, বিশ্বব্যাপী ১.৫ বিলিয়ন আইফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৩১৫ মিলিয়ন গত চার বছরে তাদের ডিভাইস আপগ্রেড করেননি এবং তাদের জন্য নতুন মডেল অপরিহার্য।
বাজার গবেষণা সংস্থা ফরস্টারের বিশ্লেষকরাও বিশ্বাস করেন যে, আইফোন এয়ারের নতুন ও সাহসী ডিজাইন আইফোনের প্রতি নতুন করে আগ্রহ জাগানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। ফরস্টারের বিশ্লেষক দীপঞ্জন চ্যাটার্জি মঙ্গলবার এক ইমেইলে লিখেছেন যে, আইফোন এয়ার সম্ভবত তাদের কাছে আবেদন জানাবে, যারা 'পার্থক্যপূর্ণ বিকল্পের অভাবে তাদের পুরোনো মডেল আপগ্রেড করতে দ্বিধা করছিলেন।'
নতুন এয়ার মডেলটি এই ইঙ্গিতও দিতে পারে যে, অ্যাপল আইফোনের ডিজাইন নিয়ে আরও বিস্তৃতভাবে ভাবছে। স্লিমনেসের (পাতলা হওয়া) ওপর এই জোর ভবিষ্যতে ফোল্ডেবল আইফোনের জন্য উপকারী হতে পারে, যদি অ্যাপল কখনও এমন ফোন তৈরি করে। গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড এবং গুগল পিক্সেল প্রো ফোল্ড-এর মতো যে ফোনগুলো অর্ধেক ভাঁজ করা যায়, সেগুলো সাধারণত বন্ধ অবস্থায় সাধারণ ফোনের চেয়ে বেশি পুরু হয়, কখনও কখনও দুটি ফোন একে অপরের ওপর স্তূপীকৃত মনে হয়। তাই পাতলা হওয়া তখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আইফোন এয়ারে একটি নতুন ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিং চিপ, যার নাম এন১, যুক্ত করা হয়েছে। অ্যাপল দাবি করছে, এটি ওয়াই-ফাই এবং ব্লুটুথের কার্যকারিতা উন্নত করবে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি অ্যাপল পোর্টবিহীন আইফোন তৈরি করতে চায়, তবে এই ধরনের সংযোগগুলোর উন্নতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ, এমন একটি ডিভাইস সম্পূর্ণরূপে ওয়্যারলেস সংযোগের ওপর নির্ভরশীল হবে। ফিন্যান্সিয়াল নিউজ আউটলেটটি মার্চ মাসে জানিয়েছিল যে, আইফোন এয়ার যদি সফল হয়, তাহলে অ্যাপল চার্জিং পোর্টবিহীন আইফোন তৈরির প্রচেষ্টা পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
স্মার্ট গ্লাসের মতো নতুন ধরনের এআই ডিভাইসগুলো একদিন স্মার্টফোনের মূল কাজগুলো প্রতিস্থাপন করতে পারে—এমন জল্পনা-কল্পনার মধ্যে একটি আরও বড় পরিবর্তনের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মেটা, গুগল এবং স্যামসাং সকলেই স্মার্ট গ্লাসে বিনিয়োগ করছে, যা ব্যবহারকারীর চারপাশের পরিবেশ বিশ্লেষণ করতে এবং প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। অন্যদিকে, ওপেনএআই অ্যাপলের সাবেক ডিজাইন প্রধান জনি আইভের সাথে একটি রহস্যময় নতুন এআই ডিভাইস নিয়ে কাজ করছে।
এর মানে এই নয় যে স্মার্টফোন শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। স্মার্ট গ্লাসের মতো পণ্যগুলো যদি জনপ্রিয়তা লাভ করে, তবে সম্ভবত মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহারের পদ্ধতি পরিবর্তন করবে। ঠিক যেমন ল্যাপটপ এবং ডেস্কটপ এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও মোবাইল যুগে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে তাদের গুরুত্ব কমেছে।
অ্যাপল এই সম্ভাব্য পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, গুগল সার্চ অ্যান্টিট্রাস্ট মামলায় আদালতের সাক্ষ্য দেওয়ার সময় অ্যাপলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অব সার্ভিসেস এডি কিউ বলেছিলেন, 'এখন থেকে ১০ বছর পর আপনার হয়তো আইফোনের প্রয়োজন নাও হতে পারে।'
আইফোন এয়ার এমন একটি যুগে অ্যাপলের স্মার্টফোন কেমন হতে পারে, তার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।