খ্যাতিমান শিম্পাঞ্জি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদী জেন গুডঅল মারা গেছেন

বিশ্বখ্যাত প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ ও সংরক্ষণবিদ জেন গুডঅল ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট জানায়, বক্তব্য দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরের অংশ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থানকালে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'ইথোলজিস্ট হিসেবে ড. গুডঅলের আবিষ্কার বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। আমাদের প্রাকৃতিক বিশ্বের সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারে তিনি ছিলেন অক্লান্ত কর্মী।'
১৯৩৪ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন জেন গুডঅল। ১৯৬০ সালে তানজানিয়ায় মুক্ত-পরিবেশে বসবাসকারী শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, যা এই প্রজাতি রক্ষায় কাজ করে এবং প্রাণী ও পরিবেশের কল্যাণে তরুণদের বিভিন্ন প্রকল্পকে সহায়তা দেয়।
তাকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিম্পাঞ্জি বিশেষজ্ঞ বিবেচনা করা হতো। তার কর্মজীবন ছিল ৬০ বছরেরও বেশি দীর্ঘ। প্রাইমেট ও মানুষের আচরণের মধ্যে সাদৃশ্য প্রমাণে তার গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই প্রখ্যাত সংরক্ষণবিদ গত সপ্তাহেই নিউইয়র্কে মঞ্চে বক্তব্য রাখেন। এর দুদিন পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি পডকাস্টে নিজের কাজ নিয়ে কথা বলেন।
আগামী ৩ অক্টোবর লস অ্যাঞ্জেলেসে দীর্ঘ জীবন ও কর্মজীবন নিয়ে একটি অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। এর পরের সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতেও আরেকটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার।

বিশ্বজুড়ে প্রকৃতি সংরক্ষণ ও প্রাণী অধিকার দাতব্য সংস্থাগুলো তার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ তার প্রশংসা করে বলেছে, তিনি 'আমাদের এই গ্রহ ও এর সব বাসিন্দার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন'।
গ্রিনপিস ইউকে-র সহ-নির্বাহী পরিচালক উইল ম্যাককালাম বলেন, গুডঅল ছিলেন 'আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংরক্ষণ দিকপাল'।
ছোটবেলা থেকেই পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় গুডঅলের। ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে তিনি কেনিয়ায় এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। সেখানেই একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের অধীনে কাজ শুরু করেন। সেই প্রত্নতাত্ত্বিকই তাকে লন্ডনে প্রাইমেটদের আচরণ নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠান।
বয়স বিশের কোঠায় থাকতেই গুডঅল তানজানিয়ার গম্বে স্ট্রিম ন্যাশনাল পার্কে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। কেবল মানুষই যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং শিম্পাঞ্জিরা নিরামিষাশী—এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহায্য করেছিল রি প্রাণীদের নিয়ে করা গুডঅলের কাজ।
পরবর্তীকালে তিনি প্রাইমেটদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও তাদের প্রতি আচরণ উন্নত করার লক্ষ্যে জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান রক্ষা করাও ছিল এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বের ২৫টিরও বেশি দেশে এর শাখা রয়েছে।

২০০২ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে 'শান্তি দূত' উপাধিতে ভূষিত হন গুডঅল। চিকিৎসা গবেষণা ও চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের ব্যবহারের বিরুদ্ধেও প্রচারণা চালান তিনি।
১৯৯১ সালে তার ইনস্টিটিউট তরুণদের প্রকৃতি সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করতে 'রুটস অ্যান্ড শুটস' প্রকল্প চালু করে। গুডঅলের সঙ্গে একদল ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে প্রকল্পটি শুরু হলেও পরে এটি প্রায় ১০০টি দেশে সক্রিয় তরুণদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে।
চলতি বছরের শুরুতে ইনস্টিটিউটের 'হোপ থ্রু অ্যাকশন' মার্কিন সরকারের তহবিল সংকটের মুখে পড়ে। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য পশ্চিম তানজানিয়ায় বিপন্ন শিম্পাঞ্জি ও তাদের বাসস্থান রক্ষা করা।
৮০ বছর বয়স পেরিয়েও গুডঅলের কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা পড়েনি। নিজের কাজ নিয়ে লেখালেখি ও বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মহামারির সময় গুডঅল 'হোপকাস্ট' নামে একটি পডকাস্ট চালু করেন; সেখানে অন্যান্য পরিবেশবিদ ও কর্মীদের সাক্ষাৎকার নিতেন।
২০০৪ সালে তিনি 'ডেম' উপাধিতে ভূষিত হন। চলতি বছরের শুরুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'মেডেল অভ ফ্রিডম' লাভ করেন।

২০২২ সালে এক ব্যতিক্রমী উপায়ে তার অবদানকে স্মরণ করা হয়। অনুপ্রেরণাদায়ী নারীদের নিয়ে বার্বি ডল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একটি সিরিজের অংশ হিসেবে তৈরি করা হয় 'জেন গুডঅল বার্বি ডল'।
২০২৩ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিশ্বের সমস্ত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে যেকোনো ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ওপর মনোযোগ দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেন, 'এই গ্রহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য আমাদের হাতে কিছুটা সময় আছে, কিন্তু সেই সুযোগ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সরকারগুলো যদি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করে, তাহলে আমাদের এখনো সুযোগ আছে।'
শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কারের প্রতি দুর্বার আকর্ষণের কথা মনে করেন। ডিম কোথা থেকে আসে, তা জানতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটি মুরগির ঘরে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, 'আমি যখন বাড়ি ফিরি, মা ততক্ষণে পুলিশকে ফোন করে দিয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা নিখোঁজ ছিলাম। বকাঝকা না করে, তিনি মন দিয়ে আমার আবিষ্কারের কথা শুনেছিলেন।'

গুডঅলের স্বপ্নপূরণের পেছনে তার মায়ের অবদান ছিল অপরিসীম। মেয়ের প্রথম অভিযানেও তিনি স্বেচ্ছায় সঙ্গী হয়েছিলেন, কারণ তখন নারীদের একা ভ্রমণের অনুমতি ছিল না।
২০২১ সালে গুডঅলের লেখা 'দ্য বুক অভ হোপ' বইটি প্রকাশ হয়। এতে তিনি স্বীকার করেন, মাঝে মাঝে তার মনে হতো তিনি এক হেরে যাওয়া যুদ্ধ লড়ছেন। তবে তিনি কীভাবে এই লড়াই চালিয়ে গেছেন, তার ব্যাখ্যাও দেন।
সেই সময়ে গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছিলেন: 'হতাশ লাগতেই পারে। কিন্তু তারপরই ভেতর থেকে কিছু একটা বলে ওঠে: "এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। আর যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা বাঁচানোর জন্যই আমাদের লড়তে হবে।"
'তখনই আমরা বাড়তি শক্তি পাই। এমন অনেক দিন গেছে যখন আমার বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করত না। কিন্তু সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ থাকত না। আমার মনে হয় এর কারণ আমি জেদি। আমি হার মানতে রাজি নই। আমি লড়াই করতে করতেই মরব, এটা নিশ্চিত।'