জেন গুডঅল: মানুষের নিকটাত্মীয় প্রাইমেটদের সম্পর্কে বোঝাপড়াকে আমূল বদলে দিয়েছেন যিনি

তিনি ছিলেন প্রকৃতির এক প্রশান্ত শক্তি। যে প্রাণীদের রক্ষায় তিনি পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের প্রতি সেই অঙ্গীকার থেকে, এই মিশন থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি। খবর বিবিসির।
গত বছরই জেন গুডঅলের সাক্ষাৎকার নেন বিবিসির এক সাংবাদিক। তিনি লিখেছনে, জেন তখনও শান্ত, সংযত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। কিন্তু সেই সুরের ভেতরেই তিনি আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে আমাদের পৃথিবী এক ভয়াবহ প্রজাতি বিলুপ্তির সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিনিধি ভিক্টোরিয়া গিল আরও বলেন, ভিডিও কলে কথা বলার সময়, কিছুটা ঝাপসা ছবির মাঝেই আমি তাঁর পেছনে দেখতে পাই খেলনা বানর "মিস্টার এইচ"কে। প্রায় ৩০ বছর আগে এক বন্ধু তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন সেই খেলনা। আজও, ৯০ বছর বয়সে আমার সঙ্গে আলাপের সময় তিনি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করছিলেন, আর তাঁর সঙ্গে সবসময় ছিল মিস্টার এইচ।
একথা অনেকের কাছে বিশ্বাস করাও কঠিন সেই বিশ্বখ্যাত প্রাণী বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবাদী ড. জেন গুডঅল আর নেই। কিন্তু এখন গবেষকরা, যারা তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিংবা কেবল তাঁর প্রাণশক্তি থেকে প্রেরণা পেয়েছেন, তাঁরা স্তব্ধ হয়ে আছেন ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর সংবাদে।
সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাট হোবাইটার, যিনি গত ১৫ বছর ধরে শিম্পাঞ্জিদের যোগাযোগ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন, আমাকে বলেন—ড. গুডঅলের প্রভাব এত গভীর হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, "তিনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাজ—শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে সময় কাটানো—ত্যাগ করেছিলেন যাতে নিরলসভাবে বিশ্বভ্রমণ করতে পারেন এবং সবার মাঝে তাঁর সেই আবেগ-ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পারেন।"
বহু বছর ধরে জেন শিম্পাঞ্জিদের পর্যবেক্ষণ করে ও তাদের নিয়ে গবেষণা করে—- আমাদের নিকটতম এই প্রাইমেট আত্মীয়দের বিষয়ে জ্ঞানের এক বিপ্লব ঘটান। তাঁর পথপ্রদর্শক আবিষ্কারগুলোর মূলে ছিল তাঁর অপার কৌতূহল আর শান্তভাবে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা।
তানজানিয়ার গোম্বে বর্ষাবনের সংরক্ষিত এলাকায় ১৯৬০ সালে তিনি এক পুরুষ শিম্পাঞ্জিকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। প্রাণীটি একটি ডাল ভেঙে, পাতাগুলো ছিঁড়ে নিয়ে সেটিকে উইপোকার ঢিবিতে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সেই ডাল ব্যবহার করে উইপোকা মুখে তুলে খেতে শুরু করে।
তাঁর এই পর্যবেক্ষণ তৎকালীন প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দেয়—যে শুধু মানুষই নাকি যন্ত্র বা টুল তৈরি ও ব্যবহার করতে পারে।
তবে প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে পাল্টে দেওয়ার পরও – জেন গুডঅলকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল সংশয় আর লিঙ্গবৈষম্যের। তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ পাননি, আর ষাটের দশকে সেটি ছিল ব্যতিক্রমী বিষয়।
গোম্বের গবেষণা থেকে তিনি দেখান—শিম্পাঞ্জিরাও শক্ত পারিবারিক বন্ধন তৈরি করে, এমনকি নিজেদের এলাকা রক্ষায় যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু প্রাণীদের এতটা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা, তাদের নামকরণ করা এবং "আমার বন্ধু" বলে উল্লেখ করা—এসব বিষয় পুরুষ-প্রধান বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁকে অজনপ্রিয় করে তোলে।
তবে তাঁর পরামর্শক ও উপদেষ্টা অধ্যাপক লুইস লিকি এই অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতির ভেতরেই মূল্য খুঁজে পান। গুডঅল তার সম্পর্কে বলে গেছেন, "তিনি (লুইস) এমন কাউকে চেয়েছিলেন যার মন বিজ্ঞানের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পশুদের বিচার করে কলুষিত হয়নি।"
তাই বৈজ্ঞানিক অঙ্গন এখনো শোকাহত এ মহৎ বিজ্ঞানীর প্রয়াণে।
রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট এড্রিয়ান স্মিথ তাঁকে বর্ণনা করেছেন "এক অসাধারণ বিজ্ঞানী, যিনি মানুষকে প্রাকৃতিক বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।"
লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামের রজার হাইফিল্ড, যে প্রতিষ্ঠান এ বছরই ড. গুডলকে ফেলোশিপ প্রদান করেছিল, বলেছেন—তিনি ছিলেন "এক অনুপ্রেরণা।"
হাইফিল্ডের মতে, "তিনি (জেন) ছিলেন দুর্দান্ত, আর এই সংবাদ সত্যিই স্তম্ভিত করার মতো। কারণ তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, অন্য প্রজাতি সম্পর্কে আমরা কীভাবে ভাবব এবং নিজেদের সম্পর্কেও কীভাবে নতুনভাবে ভাবতে হবে—তিনি মানব-অসাধারণত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।"
জেন গুডঅল শেষ পর্যন্ত তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু শিম্পাঞ্জি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন।
২০২৪ সালে বিবিসি ইনসাইড সায়েন্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলছিলেন তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের এক বৃক্ষরোপণ ও আবাসস্থল পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে, যা তখন উগান্ডায় চলছিল।
তিনি বলেন, "আমাদের হাতে এখনো কিছু সময় আছে জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের গতি শ্লথ করার। তবে এই সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।"
প্রফেসর হোবাইটার, যিনি গুডঅলের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত বিজ্ঞানীদের একজন, বলেন, "জেন প্রথমেই আমাদের বলতেন—এখন পৃথিবীর যা প্রয়োজন তা হলো না তাঁর চলে যাওয়ায় শোক করা, বরং কাজে নেমে পড়া।
আমাদের হাতে অনেক কাজ বাকি আছে, যাতে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে আমরা শেষ প্রজন্ম হব না যারা বন্য শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে পৃথিবী ভাগ করে নিয়েছিল।"