অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে বাধ্যতামূলক ডিজিটাল আইডি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে তীব্র বিতর্কে যুক্তরাজ্য

অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং কট্টরপন্থী রিফর্ম ইউকে পার্টির রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে সব কর্মজীবীর জন্য ডিজিটাল পরিচয়পত্র (আইডি) বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের এই পদক্ষেপ দেশটিতে নাগরিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবেই যুক্তরাজ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রের ধারণাটি অজনপ্রিয়। তবে লেবার সরকার বলছে, অবৈধভাবে কাজ করা কঠিন করে তোলা এবং সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি। যদিও সমালোচকদের আশঙ্কা, এটি রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়াবে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
মূলত ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী রিফর্ম ইউকে পার্টির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাই লেবার সরকারকে এই পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ব্রেক্সিট প্রচারণার নেতা নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম পার্টি জনমত জরিপে লেবার পার্টিকে ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউগভ-এর এক জরিপে দেখা গেছে, এখন নির্বাচন হলে রিফর্ম পার্টি ৩১১টি আসন পেতে পারে, আর লেবার পার্টির আসন কমে দাঁড়াতে পারে মাত্র ১৪৪টিতে।
এই রাজনৈতিক চাপ স্বীকার করে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার বলেছেন, 'আমরা দেশকে কোন পথে নিয়ে যেতে চাই, তা নিয়ে এখন দেশের অস্তিত্বের লড়াই চলছে।' তিনি আরও বলেন, তার দলসহ বামপন্থী দলগুলো এতদিন অভিবাসন নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগকে এড়িয়ে গেছে, যার সুযোগ নিয়েছে রিফর্ম পার্টির মতো দলগুলো।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, 'গভ ডট ইউকে ওয়ালেট' নামের একটি সরকারি অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের স্মার্টফোনে একটি বিনামূল্যের ডিজিটাল আইডি সংরক্ষণ করা হবে। এই আইডিতে ব্যক্তির নাম, জন্মতারিখ, জাতীয়তা, ছবি এবং যুক্তরাজ্যে বসবাসের স্থান (রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস) উল্লেখ থাকবে। চাকরি, ব্যাংকিং বা সরকারি পরিষেবা নেওয়ার সময় পরিচয় প্রমাণের জন্য এই ডিজিটাল কার্ড ব্যবহার করতে হবে।
সরকারের যুক্তি, দেশের প্রায় ১০ শতাংশ নাগরিকের পাসপোর্ট না থাকলেও ৯৩ শতাংশের হাতেই স্মার্টফোন রয়েছে। তাই এই ডিজিটাল ব্যবস্থা সবার জন্য সহজ হবে এবং পরিচয় জালিয়াতি কমাবে। সময়ের সাথে সাথে কর প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুবিধার মতো পরিষেবাগুলোও এর আওতায় আনা হতে পারে।
সরকারের এই পরিকল্পনা ঘোষণার পরপরই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র সমালোচনা। নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী, বিরোধী দল এবং বিশেষজ্ঞরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে। সমালোচকরা বলছেন, একটি সরকারি অ্যাপে নাগরিকদের সব তথ্য জমা রাখা রাষ্ট্রীয় নজরদারি এবং কর্তৃত্ববাদের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এরই মধ্যে পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে ডিজিটাল আইডির বিরুদ্ধে ১৬ লাখের বেশি মানুষ পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে।
'বিগ ব্রাদার ওয়াচ'-এর মতো নাগরিক অধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, এই ব্যবস্থা অনিবন্ধিত অভিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও কোণঠাসা করে ফেলবে। এটি তাদের জন্য শোষণ ও সামাজিক বঞ্চনার ঝুঁকি বাড়াবে।
এদিকে, বিরোধী দলগুলো এই পরিকল্পনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছে। অন্যদিকে রিফর্ম ইউকে-র নেতা নাইজেল ফারাজ বলেছেন, 'এটি ব্রিটিশ জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রকে আরও বেশি ক্ষমতা দেবে।'
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক টনি ট্র্যাভার্সের মতে, এই প্রস্তাবটি নিজে থেকে অবৈধ অভিবাসন সমস্যা সমাধানে খুব বেশি কার্যকর হবে না। এটি মূলত রিফর্ম পার্টির নির্বাচনী হুমকি মোকাবিলার একটি রাজনৈতিক কৌশল। তবে এই কৌশল কতটা সফল হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।