‘আমি জীবনকে ভালোবাসি’: যিনি মৃত্যুর তারিখ ঠিক করে রেখে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করছেন

জুলাইয়ের শেষের দিকের এক মেঘলা দিন। ল্যাঙ্কাস্টার রেলস্টেশনে সাক্ষাৎ করার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা আগে ৭১ বছর বয়সী অ্যালেক্স প্যান্ডোলফো হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠান।
তিনি লেখেন, দুই সপ্তাহ আগে আমাদের ভিডিও কলে কথা হলেও তিনি আমার চেহারা মনে করতে পারছেন না।
মজাচ্ছলে তিনি আরও বলেন, 'আশা করি আপনি এটাকে অভদ্রতা ভাববেন না… যদি আমাকে দেখেন, দয়া করে হালকা একটা ধাক্কা দিয়েন।'
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে আমি যখন তার কাছে যাই, তিনি কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। পরে চিনতে পেরে তার মুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে।
সেদিন সকালে যেন রেলস্টেশনে সময়মতো পৌঁছাতে পারেন, সেজন্য প্যান্ডোলফো আগের রাতে কয়েকটি অ্যালার্ম সেট করেন। প্রথম অ্যালার্ম বেজে ওঠে সকাল ৭টায়।
তিনি তখন বিছানা থেকে উঠে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আঁকা মরটিসিয়া অ্যাডামসের একটি ছবি এবং তার বোনের দেওয়া একটি খেলনা দেখতে থাকেন।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'প্রতিটি সকালই মূল্যবান। প্রিয় মানুষের কথা মনে করিয়ে দেওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে দারুণ লাগে।'
এরপর তিনি কফি বানিয়ে ই-মেইল চেক করেন। আরেকটি অ্যালার্ম তাকে স্টেশনে যাওয়ার সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ফোন ক্যালেন্ডারের সঙ্গে যুক্ত এই অ্যালার্মগুলোই তাকে জানিয়ে দেয় কোথায় যাচ্ছেন, আর কার সঙ্গে দেখা করবেন।
তিনি বলেন, 'নতুন নাম আর মুখ মনে রাখতে আমার খুব কষ্ট হয়, তাই নোট রাখতে হয়। এভাবে পুরনো ঘটনা মনে রাখা সহজ।'
'মৃত্যুকে কখনো ভয় পাইনি'
২০১৫ সালে প্যান্ডোলফোরের আলঝেইমার রোগ ধরা পড়ে। এটি ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ ধরন। ধীরে ধীরে মানসিক সক্ষমতা হ্রাস পায়, স্মৃতিভ্রংশ ঘটে, কথা বলার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পায়, মেজাজ ও আচরণ বদলে যায়। এ রোগের কোনো নিরাময় নেই। সেসময় তার বয়স ছিল ৬১।
বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তিনি তিন থেকে চার বছরের বেশি বাঁচবেন না। হয়তো ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারেন, তবে তখন সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় থেকে স্থায়ী পরিচর্যার প্রয়োজন হবে। তবে রোগের অগ্রগতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। কেউ সাধারণত ৫ থেকে ৮ বছর বাঁচেন, কেউ আবার ২০ বছরও বাঁচেন।
গত এক দশক ধরে প্যান্ডোলফোরের অবস্থা স্থিতিশীল। তিনি রসিকতার সুরে বলেন, 'আমি জানি না কেন এমন হচ্ছে। মস্তিষ্ক খুব অদ্ভুত জিনিস।'
এখন তিনি প্রতিদিন প্রায় ১০টি অ্যালার্ম সেট করেন। বাজারে যাওয়া, কেনাকাটা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট পর আবার মনে করিয়ে দেওয়া—সব কিছুর জন্যই নোটিফিকেশন। যদি আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকে, একটি অ্যালার্ম তাকে বাইরে বের হওয়ার কথা মনে করায়, আরেকটি আইনজীবীর নাম ও সময় মনে করিয়ে দেয়।
রাতে রান্নার সময় অ্যালেক্সা ডিভাইসে একাধিক অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন—ওভেনে দেওয়া পেঁয়াজ দেখার বা আলু কাটা শুরু করার জন্য।

তিনি বলেন, 'কখনো কারো জন্য রান্না করলে ফোনের নোটস অ্যাপে মেন্যু লিখে রাখি, যেন ভুলে না যাই। আর নতুন মেন্যু করলে পুরনো নোট মুছে দিই, যাতে বিভ্রান্ত না হই।'
বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি তিনি ম্যানচেস্টার সিটি সমর্থক ক্লাবের স্থানীয় শাখার জন্য অনুষ্ঠান আয়োজন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি, কিংবা অভিবাসী অধিকার ইস্যুতে ল্যাঙ্কাস্টারে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেওয়া প্রভৃতিতে ব্যস্ত থাকেন।
গরম দিনে সমুদ্রের ধারে একটি চেয়ার নিয়ে বসে বাতাস উপভোগ করেন। এ সময়ও মাঝেমধ্যে অ্যালার্ম বেজে ওঠে। কিন্তু একদিন হয়তো এই অ্যালার্মেও আর কাজে হবে না।
প্রত্যাশিত আয়ুর সীমা পার হয়ে আসা প্যান্ডোলফো মনে করেন, প্রতিটি নতুন দিনই এখন আর অবহেলা করার নয়। যে কোনো সময় তার মানসিক সক্ষমতা হঠাৎ কমে যেতে পারে। এমন অবস্থায় তিনি একটি দিনও বাঁচতে চান না।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'আমি কখনো মৃত্যুকে ভয় পাইনি। ভয় পাই জীবনের অর্থ হারানোর।'
'স্বাধীন থাকার অধিকার'
মোরক্যামের সবুজে ঘেরা একটি আবাসিক এলাকায় পরিচ্ছন্ন একতলা বাড়িতে একা থাকেন প্যান্ডোলফো। তার বসার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে ফ্লিটউড ম্যাক, পিঙ্ক ফ্লয়েড ও লেড জেপেলিনের মতো রক ব্যান্ডের রঙিন কনসার্ট পোস্টার, যেগুলো তার স্মৃতির জানালা খুলে দেয়, চোখে খুশির ঝিলিক আনে।
তিনি বলেন, ''আমার বয়স তখন ১১, ম্যানচেস্টারে আইস স্কেটিং করছিলাম। হঠাৎ ব্যারি ম্যাকগুইরের 'ইভ অব ডিসট্রাকশন' গানটি বাজল। গানটি আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে আমি বরফ থেকে নেমে কাঁদতে শুরু করি।''
প্যান্ডোলফোর অনুমান, তিনি জীবনে হাজারের বেশি কনসার্টে গেছেন।
তিনি বলেন, 'আমার সবচেয়ে প্রিয় কনসার্ট ছিল ১৯৭২ সালে ম্যানচেস্টার অপেরা হাউসে ক্যাট স্টিভেন্সের শো।'
প্যান্ডোলফো বলেন, 'সঙ্গীতই হৃদস্পন্দন, সঙ্গীতই জীবন।'
তার কাছে সঙ্গীত রাজনৈতিকও। হেসে তিনি যোগ করেন, 'এটা আমার রক্তে আছে। আমার মায়ের পরিবার আইরিশ, আর বাবার পরিবার ইতালীয়। আমি অ্যান্টি-মুসোলিনি আর আইরিশ রিপাবলিকান গান শুনে বড় হয়েছি।'
তিনি হেয়ার মিউজিক্যালের পোস্টারের দিকে তাকান, তার মতে এটা তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নিউ ইয়র্কে মুক্তমনা তরুণদের গল্প নিয়ে এই মিউজিক্যালে ব্যক্তিস্বাধীনতা আর সামাজিক প্রত্যাশার টানাপোড়েন দেখানো হয়েছে।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'প্রথমবার যখন দেখলাম, স্তম্ভিত হয়েছিলাম। এতে যা কিছু আছে, সবকিছুই মানুষের নিজের মতো করে বাঁচা আর যা খুশি করার স্বাধীনতা নিয়ে আমার মূল্যবোধকে গড়েছে।'
এই অনুভূতিই তাকে আরেকটি স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড় করিয়েছে— সেটা হলো মৃত্যুর অধিকার।
আপাতত তিনি কর্মব্যস্ত জীবনযাপন করছেন। তবে সময় এলে তিনি সুইজারল্যান্ডের বাসেলে যাবেন, যেখানে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ হলেও ইথানেশিয়া বৈধ নয়।
নিজের জীবনাবসানের জন্য তিনি ইতোমধ্যে একটি সুইস সংস্থার অনুমোদন পেয়েছেন।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত তাকে জীবন আরও পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে সাহায্য করছে।
'আমি হয়তো জেলে যেতাম'
প্যান্ডোলফোর বয়স যখন ১৪, তিনি এক ভূগোল শিক্ষককে হেডবাট [মাথার সামনে অংশ দিয়ে কাউকে আঘাত করা] করেন, কারণ ওই শিক্ষক তার বাবা ভিনসেন্টকে অপমান করেছিলেন। এ কারণে তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন।
ঘটনাটি স্মরণ করে তিনি হাসেন। প্যান্ডোলফো বলেন, স্কুল থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো অবস্থায় তাকে তার বাবা এমনভাবে তাকে গাড়িতে তুলেছিলেন, যেন কিছুই হয়নি।
তবে কথায় কথায় বাবা-মায়ের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গ এলে তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
১৯৯৯ সালে ৭০ বছর বয়সে তার বাবা ভিনসেন্ট এবং ২০১৭ সালে ৮৪ বছর বয়সে তার মা মেরি—দু'জনেরই ডিমেনশিয়া ধরা পড়ে। তাদের অসুস্থ হতে দেখাটাই প্যান্ডোলফোর স্বেচ্ছা মৃত্যুবিষয়ক বিশ্বাসকে দৃঢ় করেছে।
তিনি বলেন, দুজনেই শুধু স্মৃতি নয়, 'মর্যাদা, স্বাধীনতা আর নিজস্বতা' হারিয়েছিলেন।
প্যান্ডোলফো বিশেষ করে তার বাবা ভিনসেন্টের খুব কাছের ছিলেন। স্কুল থেকে বহিষ্কারের পর বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। দিনের পর দিন তারা একসঙ্গে রেডিও শুনে, বাড়ি বাড়ি কয়লা পৌঁছে দিতেন।
তিনি তার বাবাকে 'অসাধারণ ফিট' মানুষ হিসেবে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, 'তিনি ৬৫ বছর বয়সে ম্যারাথন দৌড়েছিলেন।'
তবে ১৯৯৬ সালে ভিনসেন্টের মাল্টিপল সিস্টেম অ্যাট্রফি (এমএসএ) ধরা পড়ে, তিন বছর পর ডিমেনশিয়া।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'তিনি [তার বাবা] আর দৌড়াতে পারতেন না, গাড়ি চালাতে পারতেন না, নিজের ভালো লাগার কোনো কিছুই করতে পারতেন না। এত দ্রুত তার অবনতি দেখতে দেখতে আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল।'

ডিমেনশিয়া ভিনসেন্টকে এক অচেনা মানুষে পরিণত করে।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'তিনি তখন হিংস্র আর আক্রমণাত্মক হয়ে গিয়েছিলেন, আবার একইসঙ্গে অসহায়ও ছিলেন।'
জীবনের শেষ বছরে তাকে কেয়ার হোমে ভর্তি করতে হয়েছিল, তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। অত্যন্ত গর্বিত এই মানুষটিও অসুস্থ হওয়ার আগেই স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে ছিলেন।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'তিনি [তার বাবা] বলতেন, যদি কখনো এমন অবস্থায় যাই (নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকে), তাহলে আমাকে শেষ করে দিও।'
প্যান্ডলফো স্মৃতিচারণ করেন, তিনি জীবনে মাত্র দু'বার বাবাকে কাঁদতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, 'প্রথমবার ছিল দাদির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। তখন আমি ছোট। দ্বিতীয়বার একবার যখন তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার পর বিছানা ভেজান এবং নিজে নিজে গোসল করতে পারার ক্ষমতাও ছিল না তার, সেসময়।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রায় তিন-চার বছর তিনি আমাকে একবারও অ্যালেক্স বলে ডাকেননি।
প্যান্ডলফো হঠাৎ চুপ হয়ে যান। এরপর বলেন, 'আমাকে কখনো তার ভাই ভাবতেন, কখনোবা বিলি নামের কোনো এক চেনা লোক ভাবতেন। তবে এসময় তিনি তার শৈশবের এমনসব কথাও বলেছেন, যেগুলো আগে কখনো বলেননি।'
প্যান্ডলফো বলেন, এসব কথোপকথন তাকে বাবার আরও কাছে টেনে নিয়েছিল, কিন্তু তার মন দুঃখে ভরিয়ে দিয়েছিল।
ভিনসেন্টের ডিমেনশিয়ার অবনতি হওয়ায় কোন স্মৃতিগুলো সত্যি, আর কোনগুলো নয়, তা বোঝা কঠিন ছিল।
জীবনের শেষ দিকে ভিনসেন্ট ছেলেকে অনুরোধ করতেন তার কষ্টের অবসান ঘটাতে।
প্যান্ডলফো বলেন, তিনি বলেছিলেন যে 'আমাকে সাহায্য করো, আমি শুধু মরতে চাই'।
সেই সময়ই প্যান্ডলফো প্রথম 'স্বেচ্ছামৃত্যু'র বিষয়ে খোঁজখবর নেন। যুক্তরাজ্যে এটি অবৈধ হওয়ায় তিনি সুইজারল্যান্ডে খোঁজ নেন। ১৯৪১ সালে সুইজারল্যান্ডে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বৈধতা দেওয়া হয়। সেখানে মানুষকে নির্দিষ্ট শর্তে চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা বা সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্যুর সুযোগ দেওয়া হয়, যদি তাতে ক্ষতিকর কোনো উদ্দেশ্য না থাকে।
তবে আবেদনকারীর অবশ্যই 'সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা' থাকতে হবে। ভিনসেন্টের ডিমেনশিয়া এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে শর্ত অনুযায়ী তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা ছিল না।
প্যান্ডলফো দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, 'যদি কেউ বলত তুমি তাকে ওই ট্যাবলেটটা দিলে বা ওই সুচটা তার শরেীরে ফোটালে সে শান্তিতে মারা যাবে'—আমি সেটাই করতাম। আমি হয়তো জেলে যেতাম, কিন্তু আর তার কষ্ট নিজ চোখে দেখা লাগতো না।'
২০০৪ সালে ৭৫ বছর বয়সে ভিনসেন্ট মারা যান। ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও মৃত্যুর আগে তার শেষ কথাগুলো আজও প্যান্ডলফোর মনে দাগ কেটে আছে।
ডিমেনশিয়ার শেষ পর্যায়ে ভিনসেন্ট খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু একসময় ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, 'তুমি বলেছিলে, আমাকে এমন হতে দেবে না, কিন্তু তুমি তা করেছ।' এরপর আর কখনো কথা বলেননি তিনি।
প্যান্ডলফো শান্ত কণ্ঠে বলেন, 'ওগুলোই ছিল তার শেষ কথা।'
তিনি বলেন, বাবার এই শেষ কথাগুলো তাকে তাড়া করে বেড়ায় না, কারণ তিনি জানেন বাবা আর আগের মতো ছিলেন না। তবুও সেই অভিযোগের ভার তাকে আজও ভাবায়।
'নতুন করে বাঁচা শুরু'
২০১৫ সালে প্যান্ডলফোর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণের লক্ষণ দেখা দেয়। তখন তিনি শিক্ষা পরামর্শক [এডুকেশন কনসালটেন্ট] হিসেবে কাজ করতেন।
সেসময় ক্লায়েন্টরা তাকে জানায়, তার পাঠানো ই-মেইলগুলো বোঝা যায় না।
তিনি বলেন, 'আমি নিজেই আমার লেখা ই-মেইলগুলো দেখলাম এবং বুঝতে পারলাম আমার কিছু একটা হচ্ছে। বানান পুরো গুলিয়ে গেছে। কম্পিউটার চালু করতাম; এরপর হঠাৎ দেখতাম বিকেল হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথায় গেল জানি না।'
তিনি বুঝতে পারেন, তার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে কাজ করতে করতেই বুঝতে পারতেন না তিনি কী করছেন।
একবার তিনি হাইকিংয়ে যেতে গাড়ি চালিয়ে স্কটল্যান্ডের একটি গ্রামে যান। বৃষ্টির মধ্যে ওয়াটারপ্রুফ পোশাক পরার সময় হঠাৎ বুঝতে পারছিলেন না তিনি কোথায় আছেন বা কী করছেন।
অবশেষে তিনি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করান।

প্যান্ডলফো বলেন, আলঝেইমারের মতো ভয়ংকর রোগ নির্ণয়ের মুহূর্তটাও তিনি খুব স্পষ্ট মনে রেখেছেন।
সেটা ছিল মার্চ মাস। ক্লিনিকের রিসেপশনের দেয়ালে একটি ছোট গাছের ছবি ছিল। সেখানে রোগীরা তাদের ইচ্ছা কাগজে লিখে টাঙিয়ে রাখত।
সামান্য হেসে তিনি বলেন, ''আমি কাগজে 'শান্তি' শব্দটি লিখে কাগজটা টাঙালাম, এরপর ডাক্তারের কক্ষে ঢুকলাম।''
দুইজন ডাক্তার আর সামনে টিস্যুর বাক্স দেখে তিনি বুঝেছিলেন খবর খারাপ।
রোগ নির্ণয়ের কয়েক সপ্তাহ পরই প্যান্ডলফো সুইজারল্যান্ডের একটি স্বেচ্ছামৃত্যুকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাকে চিকিৎসা-সংক্রান্ত নথি, দুইজন পেশাদার চিকিৎসকের মূল্যায়ন, অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য ও একটি ব্যক্তিগত বিবৃতি জমা দিতে হয়। ছয় সপ্তাহ পর ই-মেইলে তিনি অনুমোদনের খবর পান।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হলো, কাঁধ থেকে বোঝা নেমে গেছে। আমি এখন আবার বাঁচা শুরু করতে পারি।'
তিনি হাসিমুখে বলেন, 'আমি মরতে চাই না। আমি জীবনকে ভালোবাসি। তাই সবসময় জীবনকে উপভোগ করেছি। কিন্তু যদি আলঝেইমারে আমার নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণই না থাকে, তবে সে অবস্থায় বেঁচে থাকাটা হবে নদীর স্রোতে ভেসে গিয়ে ঘাসের ডগা ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করার মতো।'
যদি আবেদনটি অনুমোদন না পেত তাহলে ২০১৭ সালেই নিজের জীবন শেষ করতেন বলে জানান প্যান্ডলফো। তবে তিনি খুশি যে সেটা করতে হয়নি।
তিনি মনে করেন, তার মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তদের কাছে আইনসিদ্ধ মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর সুযোগ না থাকলে, আত্মহত্যা হলো মরিয়া শেষ চেষ্টা।
তিনি বলেন, 'আমি এমনভাবে মরতে চাই, যাতে নিজের প্রতি এবং অন্যদের প্রতি সম্মান থাকে।'
কিছুক্ষণ থেমে তিনি বলেন, 'অনুমোদন পাওয়ার পর মনে হলো, আমার জীবন বাঁচল। আমাকে আর নিজেকে মেরে ফেলতে হবে না।'
'মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি'
নিজের আলঝেইমারের খবর মাকে জানানোটা প্যান্ডলফোর জন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার চেয়েও কঠিন বিষয় ছিল। তিনি তিন সপ্তাহ মায়ের কাছে এ কথা গোপন রাখেন। প্রথমে ছোট বোনকে জানান, আশা করেন সে হয়তো মাকে বলবে।
তিনি বলেন, 'প্রাকৃতিক নিয়ম হলো বাবা-মা আগে চলে যান। আর বাবারও একই রোগে মৃত্যুর ক্ষতটাও তখনো কাঁচা ছিল।'
অবশেষে তিনি মাকে ফোন করেন। এ খবর শোনার পর মায়ের প্রথম কথা ছিল, 'মনে হয় তুমি সুইজারল্যান্ডে আবেদন করবে, তাই না?'
তিনি হ্যাঁ বললে মা বলেন, 'ভালো ছেলে, ঠিক করেছ।'
ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হওয়া সত্ত্বেও মায়ের এই সমর্থন প্যান্ডলফোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তিনি বলেন, 'এটা ছিল আমাদের দু'জনের জন্যই এক মিশ্র অনুভূতি।'

২০১৭ সালে মেরি নিজেও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। তাকে চলাফেরা ও সচেতনতা হারাতে দেখে প্যান্ডলফো ভয় ও দুঃখ পান।
তিনি বলেন, 'তাকে ওই অবস্থায় দেখা কষ্টকর ছিল। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল, তার পাশে ভালোবাসার মানুষেরা ছিল।'
কখনো কখনো তিনি মায়ের পাশে বসে বসে ঘুমন্ত অবস্থায় তার [মায়ের] নিঃশ্বাস নেওয়া দেখতেন। প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়া দেখে তিনি মনে মনে চাইতেন, এটিই যেন শেষ নিঃশ্বাস হয় এবং তিনি কষ্ট থেকে মুক্তি পান।
প্যান্ডলফো বলেন, 'মা মারা গেলে আমি বিধ্বস্ত হয়েছিলাম। তবে শুনতে নির্মম আর ভয়ংকর শোনালেও, একই সঙ্গে আমি স্বস্তিও পেয়েছিলাম।'
'সবার মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর অধিকার আছে'
বহু বছর ভিনসেন্টের যত্ন নিতে গিয়ে প্যান্ডোলফোর জীবন পুরোপুরি প্রাণহীন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, 'আমি যেন ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কে।'
তিনি আরও বলেন, 'তারপর এল আমার রোগের খবর, আর মা-ও অসুস্থ হলেন। তখনই আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করি—আমি কে? আমি কী করছি, আর কী করতে পারি?'
পরবর্তীতে জীবন নিয়ে তিনি বাস্তবধর্মী চিন্তাভাবনা করেন।
তিনি বলেন, আমি ভাবি 'আমি নেতৃত্বে পারদর্শী, জনসমক্ষে বক্তৃতাতেও মোটামুটি ভালো, আর বয়স্ক শ্রোতাদের সম্পর্কে ভালো জানি; কারণ আগে ট্রেড ইউনিয়ন আর বাস চালিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি আমি আর কাজ করতে না পারি, তাহলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জীবন কাটাব, আর এই দেশে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইন পরিবর্তনের জন্য কাজ করব।'
ধীরে ধীরে তিনি তার সমমনা বিভিন্ন তৃণমূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে জনসমক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে শুরু করেন।
বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ 'দ্য রাইট টু ডাই উইথ ডিগনিটি'-র সক্রিয় সদস্য। সামাজিক মাধ্যমে তিনি মারাত্মক অসুস্থ বা আলঝেইমারের মতো রোগে আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়ে বার্তা পান।
কখনো কখনো তিনি মানুষকে সুইজারল্যান্ডে শেষযাত্রায় সঙ্গ দেন। তাদের শেষ দিনগুলো তিনি পাশে থাকেন। তারা যখন সন্তানের জন্য শেষ বার্তা লিখে জীবনাবসান করেন, তিনি তাদের হাত ধরে থাকেন।
গত জুনে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে টার্মিনালি ইল অ্যাডাল্টস (এন্ড অব লাইফ) বিল ৩১৪-২৯১ ভোটে অল্প ব্যবধানে পাস হয়েছে। এখন এটি আরও পর্যালোচনার জন্য হাউস অব লর্ডসে পাঠানো হয়েছে।
'ডিগনিটি ইন ডায়িং'- ক্যাম্পেইনের মতো সমর্থকেরা এটিকে মরণাপন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতির একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে।

তবে বিরোধীরা, যার মধ্যে ধর্মীয় সংগঠন, প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী ও রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টসের মতো চিকিৎসা সংগঠনও আছে, গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তাদের মতে, আইনটি জোরপূর্বক প্রভাব খাটানোর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, এনএইচএসের ওপর চাপ বাড়াতে পারে, চিকিৎসকদের নৈতিক সংকটে ফেলতে পারে এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলোচনার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি।
বিলটি পাস হলে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ১৮ বছরের বেশি বয়সী, যারা অন্তত ১২ মাস নিবন্ধিত চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন, মানসিকভাবে সমর্থ এবং 'প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে ছয় মাসের মধ্যে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে'—তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করতে পারবেন।
প্যান্ডোলফো বলেন, এই ছয় মাসের শর্ত তার মতো স্নায়বিক অবনতিশীল রোগীদের জন্য বঞ্চনামূলক।
যদিও মে মাসের ইউগভ জরিপে দেখা গেছে ৭৫ শতাংশ ব্রিটিশ স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ করার পক্ষে। তবুও আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে গড়ে সপ্তাহে একজন সুইজারল্যান্ডে গিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করছেন। এর খরচ প্রায় ১৫ হাজার পাউন্ড (২০ হাজার ৫০০ ডলার)।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর অধিকার সবার থাকা উচিত, শুধু যাদের সামর্থ্য আছে তাদের নয়।'
'সময় হারিয়ে যাচ্ছে'
আমাদের সাক্ষাতের কয়েক দিন পর প্যান্ডোলফোর কিডনির পাথর অপসারণের অস্ত্রোপচার হয়।
নিজের বাড়িতে ফিরে এসে এক ভিডিও কলে তিনি আলঝেইমার নিয়ে বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা নিয়ে ভাবেন।
প্যান্ডোলফো বলেন, 'আমি এটাকে সম্পর্কের মতো ভাবি। কখনো সমতা থাকে, কখনো অন্য পক্ষের ক্ষমতা বেশি থাকে। আমি চেষ্টা করি এটা নিয়ে খুব বেশি না ভাবতে।'
গত এক দশকে তিনি মানসিক কাজের চাপ কমানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, 'এটা আসলে অগোছালো জিনিস গুছিয়ে ফেলার মতো। কারণ আমি আমার মস্তিষ্ককে কম্পিউটার মনে করি। এটা অনেক কিছু গ্রহণ করে, আমাকে ঠিক করতে হয় কোন তথ্যটা রাখব, কোনটা বাদ দেবো। আমি আমার ওষুধ, রুটিন, কাছের মানুষের নাম মনে রাখতে চাই।'

তার এখনও মাঝে মাঝে 'সময় হারানোর' দুঃখ হয়।
তিনি বলেন, 'এটা আমার স্মৃতির সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি। যেমন: আমি নোটবুকে কিছু লিখলে পরে বোঝার উপায় থাকে না এটা গত মাসে, গত বছর নাকি আজ সকালে লিখেছি।'
একসময় তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার।
তিনি বলেন, 'আমাকে মানসিকভাবে এতটা সুস্থ থাকতে হবে যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারি কখন আমাকে যেতে হবে।'
দৃশ্যটা তিনি বহুবার কল্পনা করেছেন। যদি তিনি পারতেন, তবে নিজের বাড়ির সোফায় বসে বাগানের দিকে তাকিয়ে মরতে পারাটাকে বেছে নিতেন।
তিনি হেসে বলেন, 'আমি চাই দিনটি এমন হবে যে আমি বাড়ির দরজা খোলা রাখব, যার ইচ্ছা সে আসবে, সারাদিন সঙ্গীত বাজবে, আর আমি প্রচুর নিরামিষ খাবার রান্না করব।'
তিনি জানান, কিন্তু যুক্তরাজ্যের আইন না থাকার কারণে তাকে সুইজারল্যান্ডে 'ছোট একটি উদযাপন' করেই শেষযাত্রা করতে হবে। সেখানে যাদের ইচ্ছে হবে তারা তাকে সঙ্গ দেবে।
তিনি আরও বলেন, 'আর শেষ গানটা হবে রকি হরর পিকচার শো–এর টাইম ওয়ার্প।'
এখন তার আশা, চিকিৎসায় পায়ের ব্যথা কমলে তিনি আবার মোটরসাইকেল চালাবেন। আরও অনেক কনসার্টে যেতে চান তিনি। অ্যালঝেইমার যেন জীবনের বাকি সময়কে আটকে না দেয়, সে চেষ্টা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমি দুঃখী হতে চাই না। আমি সুখী হতে চাই। আমি ভাগ্যবান, কারণ সারাজীবন আমি সবকিছুতে আনন্দ খুঁজে পেয়েছি—এমনকি জানালার বাইরে তাকিয়েও।'
তিনি আরও বলেন, মৃত্যু আর কেউ কীভাবে মারা যাচ্ছে—দুটো আলাদা বিষয়। 'এখন আমি জানি যে আমাকে দীর্ঘ, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু সহ্য করতে হবে না। তাই আমি আর কোনোটাকেই ভয় করি না।'