ভারত কি পাকিস্তানকে প্লাবিত করতে ‘পানিকে অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে?

গত তিন বছরে দ্বিতীয়বারের মতো ভয়াবহ মৌসুমি বন্যা পাকিস্তানের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল, বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে, ফসলের জমি ডুবে গেছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং শত শতের বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।
তবে এবার শুধু পাকিস্তান নয়; ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মাঝে তার পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী ভারতও একই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত। ভারী বর্ষণে সীমান্তের উভয়পাশের নদী ফুলে ফেঁপে উঠায় ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো—হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং ভারতীয় পাঞ্জাবও ব্যাপক বন্যায় জর্জরিত।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জুনের শেষ থেকে চলা বর্ষা মৌসুমে দেশজুড়ে অন্তত ৮৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ২২০-এর বেশি নিহত পাঞ্জাব প্রদেশে। অন্যদিকে, ভারতে হতাহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে; ভারতীয় পাঞ্জাবে ৩০-এর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
তবে এই অভিন্ন দুর্ভোগ দুই প্রতিবেশীকে কাছাকাছি আনতে পারেনি। বরং পাকিস্তানের পাঞ্জাবের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আহসান ইকবাল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তার দাবি, ভারত সময়মতো সতর্ক না করে বাঁধ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়েছে, যার ফলে পাঞ্জাবে ব্যাপক বন্যা হয়েছে।

ইকবাল গত মাসে বলেন, 'ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এবং পাঞ্জাবে ব্যাপক বন্যা ঘটিয়েছে।' তিনি ভারতের ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানে প্রবাহিত রবি, সুতলেজ ও চেনাব নদীর পানি ছাড়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, ভারতের এই পদক্ষেপ 'সবচেয়ে জঘন্য পানি আগ্রাসনের উদাহরণ', যা দেশটির জানমাল, সম্পত্তি ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ২৭ আগস্ট নারোওয়াল শহরে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সময় তিনি বলেন, 'কিছু বিষয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা উচিত এবং পানি সহযোগিতা তার মধ্যে অন্যতম।'
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার পর চলতি বছর এপ্রিল মাসে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবিয়ে দেওয়ার অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণ নেই। বরং ভারতের নিজেদের বিপর্যয়ও এমন কৌশলের ঝুঁকি নির্দেশ করে। ভারতের বড় বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়লে প্রথমে ভারতের নিজ রাজ্যগুলোই উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এমনিতেই তলানিতে থাকা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয় এপ্রিলে পাহেলগাম হামলার পর। ভারত-শাসিত কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের ২৬ বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। এরপর সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদী পরিচালনা বিষয়ক চুক্তি, সিন্ধু জলচুক্তি (আইডব্লিউটি) থেকে ভারত সরে আসে। যদিও পাকিস্তান হামলায় তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে।

মে মাসে প্রায় তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সামরিক উত্তেজনায় দুই দেশ চার দিনব্যাপী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সংঘাতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করে একে অপরের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়।
সিন্ধু জলচুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশকে নিয়মিতভাবে পানি প্রবাহের বিস্তারিত তথ্য আদান-প্রদান করতে হতো। তবে ভারত সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই চুক্তি মেনে চলেনি, যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, দিল্লি হয়তো পাকিস্তানে পানি প্রবাহ সীমিত করবে বা হঠাৎ বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দিতে পারে।
নয়াদিল্লি আইডব্লিউটি থেকে অংশগ্রহণ স্থগিত করার পর, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জুনে জানিয়েছেন, এই চুক্তি আর কখনো পুনরুদ্ধার করা হবে না। পাকিস্তান এই অবস্থানে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং 'পানি সন্ত্রাসবাদের' অভিযোগ উত্থাপন করেছে।
তবে পাকিস্তানকে প্লাবিত করার অভিযোগে ভারত সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশন মানবিক কারণে সম্ভাব্য আন্তঃসীমান্ত বন্যা নিয়ে কয়েকটি সতর্কবার্তা জারি করেছে।
পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের বাঁধ থেকে পানি ছাড়াকে পাকিস্তানের বন্যার একমাত্র কারণ হিসেবে ধরা 'অতিসরলীকরণ'। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পুরোনো অবকাঠামোই মূল চ্যালেঞ্জ। কিংস কলেজ লন্ডনের ক্রিটিক্যাল জিওগ্রাফির অধ্যাপক দানিশ মুস্তফা আল জাজিরাকে বলেন, 'ভারতের নদীতে বড় বাঁধ থাকলেও, অতিরিক্ত পানি ছাড়লে প্রথমে ভারতের নিজ রাজ্যগুলোই গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে; পাকিস্তানে সরাসরি বন্যা সৃষ্টি হবে না।'
৩ সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের খবরে অন্তত একটি ডজন স্থানে 'মারাত্মক' বন্যার পরিস্থিতি বিরাজ করছে, আর আরও ১৯টি স্থান স্বাভাবিক বন্যার মাত্রার উপরে রয়েছে।
একই দিনে পাকিস্তানের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাইকমিশনের বার্তাকে উল্লেখ করে সুতলেজ ও তাউই নদীতে 'উচ্চ বন্যার' আশঙ্কা জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। গত সপ্তাহে তিনটি সতর্কবার্তার পর এটি ভারতের চতুর্থ এমন বার্তা, তবে কোনোটিতেই বিস্তারিত হাইড্রোলজিক্যাল তথ্য দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানের আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে জানায়, সুতলেজ ও রবি নদীর দুটি স্থানে 'অত্যন্ত উচ্চ' বন্যার মাত্রা, আর রবি ও চেনাব নদীর অন্য দুটি স্থানে 'খুব উচ্চ' মাত্রা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, তীব্র বর্ষার সময় পানির বিশাল পরিমাণ প্রায়শই কোনো একক বাঁধ বা ব্যারেজের ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সীমান্তের উভয় পাশে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ছাড়া এখন বন্যা ব্যবস্থাপনার একটি অপরিহার্য অংশ, যদিও ঝুঁকিপূর্ণ।
তারা আরও বলেন, সিন্ধু জলচুক্তি ভারতকে অস্বাভাবিক প্রবাহের বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করতে বাধ্য করলেও, উন্নত পর্যবেক্ষণ এবং রিয়েল-টাইম ডেটা সিস্টেমের প্রয়োজন। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে দোষারোপের এই খেলা উভয় পক্ষের স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে—ভারতের জন্য এটি পাকিস্তানের রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষকিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান হিসেবে, পাকিস্তানের জন্য এটি অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে মনোযোগ সরানোর একটি কৌশল হিসেবে।
শিক্ষাবিদ মুস্তাফা বলেন, 'নদীগুলো জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া সত্তা। তারা সব সময় গতিশীল থাকে। আপনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, বিশেষ করে উচ্চ বা মারাত্মক বন্যার সময়। ভারতকে দোষারোপ করলে বন্যা থামবে না। যদিও, এটি 'দায়িত্ব ত্যাগ করার একটি সহজ উপায়'।