ড্রাগন বল জি থেকে ডেমন স্লেয়ার: অ্যানিমে যেভাবে আমেরিকা জয় করলো
একসময় 'কার্টুন' মানেই ছিল ডিজনি, কিন্তু যুগ পাল্টেছে। এখন অ্যানিমেশনের দুনিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য এক জাপানি বিস্ময়ের যাকে বলে অ্যানিমে। ওয়াল্ট ডিজনির মতোই, 'অ্যানিমে' এখন কেবল একটি ছবির ধরন নয়, বরং গল্প বলার এক অনন্য উপায়।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকান কিশোর-কিশোরীদের জন্য এই জগতে প্রবেশের দরজাটা খুলে দিয়েছিল বুটলেগ ভিএইচএস ক্যাসেটে দেখা 'আকিরা' নামের একটি ফিল্ম। কাতসুহিরো ওতোমোর এই মাস্টারপিস ছিল তাদের চেনা জগতের বাইরের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সিনেমার প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকরা যেন এক ঘোরের মধ্যে আটকে গিয়েছিল। পারমাণবিক বোমায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া টোকিওর বুকে জেগে ওঠা 'নব্য-টোকিও'র গল্প—যেখানে বাইকার গ্যাং, রহস্যময় আধ্যাত্মিক শক্তি আর দুর্নীতিগ্রস্ত সামরিক বাহিনীর বসবাস। এই জগৎটা ছিল আমেরিকান কার্টুনের চেনা ছকের বাইরের এক অন্য ভুবন।
'আকিরা'র সঙ্গীত থেকে শুরু করে এর জটিল চরিত্র সবকিছুতেই ছিল সতেজতা আর উত্তেজনার ছোঁয়া। ব্যাপারটা এতটাই নতুন ছিল যে, আমেরিকানরা তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, এই নতুন জিনিসটাকে কী নামে ডাকা যায়। অ্যানিমে, জাপানিমে, নাকি জাপানিমেশন? তবে নামের এই ধোঁয়াশা এর জনপ্রিয়তায় কোনো বাধা হতে পারেনি। চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট তো একে 'চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা আন্ডারগ্রাউন্ড কাল্ট' বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এবার্ট বিশেষভাবে 'আকিরা' এবং 'ঘোস্ট ইন দ্য শেল'-এর মতো অ্যানিমে দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সাইবর্গ পুলিশ, হ্যাকার সন্ত্রাসী আর প্রযুক্তির জগতে পরিচয়ের সংকট নিয়ে তৈরি এই অ্যানিমেগুলোর গল্প ও দৃশ্যকল্প পরবর্তীতে 'দ্য ম্যাট্রিক্স'-এর মতো সিনেমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এটা এখন স্পষ্ট যে, এই অ্যানিমেগুলো ভবিষ্যতের এক ঝলক দেখায়। একবিংশ শতাব্দীর বহু আগেই এক অস্থির, সন্দিহান আর প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল তারা।
তবে শুধু গল্প নয়, অ্যানিমেশনের ধরনটাও ছিল একেবারেই আলাদা। আমেরিকান কার্টুনের মসৃণ গতির চেয়ে এর দৃশ্যগুলো ছিল কিছুটা ভিন্ন, যা দর্শকদের জন্য ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা।
মাঙ্গা থেকে অ্যানিমে
অ্যানিমের এই স্বতন্ত্র স্টাইলের জন্ম আসলে মাঙ্গা কমিকসের সূত্র ধরে। জাপানের 'উইকলি শোনেন জাম্প'-এর মতো ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত মাঙ্গা সিরিজ থেকেই বহু জনপ্রিয় অ্যানিমের জন্ম। নব্বইয়ের দশকে এই ম্যাগাজিনের পাঠক সংখ্যা ছিল প্রায় ষাট লাখ, যাদের অধিকাংশই ছিল কিশোর।
এই সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর ব্যবসায়িক মডেল অ্যানিমের গল্প বলার ধরনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। মাঙ্গা নির্মাতাদের প্রতি সপ্তাহে নতুন গল্প আর ছবি জমা দিতে হতো। এই চাপের মুখেই জন্ম নিতো অপ্রত্যাশিত সব মোড় আর সৃজনশীলতা। অনেক সময় দেখা যেত, গল্পের পরবর্তী অংশ ভাবতে ভাবতেই পুরো একটি পর্ব জুড়ে চলত বিশাল এক লড়াইয়ের দৃশ্য, যা পাঠকদের উত্তেজনার তুঙ্গে রাখত।
আমেরিকায় অ্যানিমে: সেন্সরশিপের মজার দিনগুলো
নব্বইয়ের দশকে অ্যানিমের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল কল্পনাতীত। তখন অ্যানিমে মানেই ছিল চোরাই ভিএইচএস ক্যাসেট আর হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির আনা ডাব করা সংস্করণ। সেই ডাবিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল আরও মজার। ইংরেজি ভয়েস আর্টিস্টরা প্রায়ই জানতেন না, কোন দৃশ্যে কীসের সংলাপ বলছেন!
আমেরিকান টেলিভিশনের কঠোর সেন্সরশিপের নিয়ম মানতে গিয়ে নির্মাতাদের নানা রকম অদ্ভুত উপায় বের করতে হতো। ভয়েস অভিনেতা টেরি ক্লাসেনের মতে, তাদের এমনভাবে কাজ করতে হতো যেন আমেরিকার 'বাইবেল বেল্ট' বা রক্ষণশীল দর্শকরা অসন্তুষ্ট না হন। এর ফলে, প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম সবকিছুই বদলে ফেলা হতো। কখনও চরিত্রের নাম পাল্টে যেত, যেমন 'মিস্টার স্যাটান' হয়ে যেতেন 'হারকিউল'। আবার কখনও অ্যানিমেশনের দৃশ্যও পাল্টানো হতো, যেমন বিয়ারের গ্লাসকে বানিয়ে দেওয়া হতো কমলার জুসের গ্লাস।
'ড্রাগন বল জি'-এর এক কুখ্যাত দৃশ্যে নরকের দৈত্যদের টি-শার্টে লেখা 'HELL' শব্দটিকে বদলে 'HFIL' (হোম ফর ইনফিনিট লুজারস) বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল! 'পোকেমন'-এ জাপানি খাবার 'রাইস বল'কে পরিচিত 'জেলি ডোনাট' বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি 'ডোরেমন' সিরিজে ফার্স্ট-এইড কিটের ছবি বদলে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল পিৎজার ছবি!
তবে এতোকিছুর পরেও, সবাই চাইতেন গল্পের মূল আবেগটা যেন ঠিক থাকে, যদিও গল্পের আগামাথা বোঝাটা মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ত।
টুনামি: যে বিপ্লব সব বদলে দিল
আমেরিকায় অ্যানিমের ইতিহাস বদলে দেওয়ার গল্পটা শুরু হয়েছিল 'কার্টুন নেটওয়ার্ক' চ্যানেল থেকে। সেই সময়ে চ্যানেলের দুই ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, জেসন ডিমার্কো এবং শন একিন্স, একটি বড় দায়িত্ব পান। তাদের স্কুলের পর বাচ্চাদের জন্য 'টুনামি' নামে একটি নতুন অনুষ্ঠান-স্লট আকর্ষণীয় শিশু-কিশোরদের উপযুক্ত শো দিয়ে পূরণ করতে হতো।
নতুন কিছু খুঁজতে গিয়ে তারা এক অদ্ভুত কাজ করতেন। আটলান্টার একটি ভিডিও দোকান থেকে জাপানি অ্যানিমের ক্যাসেট ভাড়া আনতেন। ভাষাটা ছিল পুরোপুরি অজানা, কিন্তু তাতে কিছু যেত-আসত না। অ্যানিমের ছবির ধরন, চরিত্রদের ডিজাইন আর নড়াচড়ার ভঙ্গি এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, তারা শুধু দেখেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। ভাষা না বুঝেও তারা বুঝেছিলেন, এটাই সেই নতুন জিনিস যা তারা খুঁজছিলেন।
এভাবেই তাদের চোখে পড়ে 'ড্রাগন বল জি'। এর আগে এবিসি-র মতো বড় নেটওয়ার্কগুলো এই সিরিজটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ তাদের মতে আমেরিকার দর্শকরা ধারাবাহিক গল্পের চেয়ে এক পর্বে শেষ হয়ে যাওয়া কার্টুন বেশি পছন্দ করে। কিন্তু টুনামিতে ১৯৯৮ সালে সম্প্রচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই 'ড্রাগন বল জি' ইতিহাস গড়ে। এক বছরের মধ্যে এটি কার্টুন নেটওয়ার্কের এক নম্বর শোতে পরিণত হয়।
এই প্রথম আমেরিকার শিশুরা এমন এক কার্টুন দেখলো, যেখানে চরিত্রগুলো বড় হয়, প্রেমে পড়ে, এমনকি মারাও যায়। প্রতিটি পর্বের শেষে গল্পটা শেষ হয়ে যায় না, বরং এগিয়ে চলে।
'ড্রাগন বল জি' আর 'পোকেমন' এই দুটো শো ছিল আমেরিকার অ্যানিমে ভক্তদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। পোকেমন শুধু একটি শো ছিল না, এটি ট্রেডিং কার্ড, খেলনা আর পোশাকের মাধ্যমে এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং ইতিহাসের সর্বোচ্চ আয়ের মিডিয়া ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পরিণত হয়।
অস্কার জয় এবং সংস্কৃতির মূলধারায় প্রবেশ
শিশুদের গণ্ডি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে অ্যানিমেকে শৈল্পিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক হায়াও মিয়াজাকি। তার 'মাই নেইবার তোতোরো' বা 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে'র মতো চলচ্চিত্রগুলো অ্যানিমেশন সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দেয়। ২০০৩ সালে 'স্পিরিটেড অ্যাওয়ে' যখন সেরা অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের জন্য অস্কার জিতে নেয়, তখন ওয়াল্ট ডিজনির মতোই অ্যানিমে শৈল্পিক মর্যাদার আসনে বসে।
এরপর অ্যানিমের প্রভাব আমেরিকান পপ সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে। হিপ-হপ জগতে র্যাপাররা তাদের গানে গোকু বা নারুটোর রেফারেন্স দিতে শুরু করেন। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো অ্যানিমের চরিত্র নিয়ে পোশাক তৈরি করতে থাকে, এমনকি অলিম্পিকের মঞ্চেও খেলোয়াড়দের অ্যানিমে চরিত্রের অনুকরণে ভিক্টরি পোজ দিতে দেখা যায়।
বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে অ্যানিমের জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। জাপানের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ-মালিকানাধীন অ্যানিমেশন স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা আর্থেল আইসোমের মতে, অ্যানিমের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করা চরিত্রগুলোর সঙ্গে তারা নিজেদের মেলাতে পারতেন।
অ্যানিমের ভবিষ্যৎ
আজ জাপানি অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রির আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে, যার মধ্যে উত্তর আমেরিকা অন্যতম। জেন জি প্রজন্মের কাছে অ্যানিমে এখন অ্যানিমেশনের সমার্থক। এমনকি 'অ্যাভাটার: দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার'-এর মতো আমেরিকান শো-ও অ্যানিমের স্টাইল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়েছে। এখন 'লর্ড অফ দ্য রিংস' বা 'স্টার ওয়ার্স'-এর মতো হলিউডি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও তাদের গল্পের অ্যানিমে সংস্করণ তৈরি করছে।
প্রশ্ন হলো, অ্যানিমে কি মূলধারার অংশ হতে গিয়ে তার স্বকীয়তা আর কাউন্টারকালচারের আবেদন হারিয়ে ফেলবে?
সম্ভবত না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, অ্যানিমে তৈরির জন্য যে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন, তার জোগান এখনো সীমিত। দ্বিতীয়ত, জাপানে অ্যানিমের স্বত্ব সাধারণত এর মূল মাঙ্গা স্রষ্টার কাছেই থাকে। ফলে কর্পোরেট চাপে পড়ে গল্পের বিকৃতি ঘটানো প্রায় অসম্ভব।
তবে অ্যানিমের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হলো এর নিজস্ব পাগলামি। 'মাই নেইবার তোতোরো'-এর মতো গল্প, যেখানে শিশুরা একটি বিড়াল-বাসের বন্ধু হয়, তা কোনো বাজারজাতকরণ ফর্মুলা দিয়ে তৈরি করা যায় না। অ্যানিমে হলো অদ্ভুত এবং খামখেয়ালি কল্পনার এক অবাধ বিচরণক্ষেত্র। হলিউডের ফর্মুলা-ভিত্তিক দুনিয়ায় অ্যানিমের এই খামখেয়ালিপনাই হয়তো এর টিকে থাকার সবচেয়ে বড় বর্ম।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা
