সাগরে আধিপত্যের লড়াই: রেকর্ড গতিতে বাড়ছে চীনের নৌ-শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রকে ধরতে আর কতদূর?

'সমাজতন্ত্রই ভালো...' বেসুরো গলায় পোর্টেবল কারাওকে মাইকে গেয়ে উঠলেন এক বৃদ্ধা, বন্ধুদের কলরবে তার কণ্ঠস্বর তখন কিছুটা চাপা পড়ে যাচ্ছিল।কিন্তু পরের পঙক্তিতে সমবেত সুরে তার সাথে যোগ দিলেন বাকিরাও: 'চীনকে শক্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি!'
জনপ্রিয় গানের তালিকায় এটি হয়তো শীর্ষে নেই। তবে ক্রেনশোভিত যে দিগন্তে নানা আকারের জাহাজ সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা, সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে এই গানটি গাওয়া সত্যিই মানানসই।
চীনের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের ডালিয়ানে, পীত সাগরমুখী সুইয়ুয়ান পার্ক থেকে দেখা যায় দেশটির বৃহত্তম জাহাজ নির্মাণ ইয়ার্ডের মনোরম দৃশ্য। এই পার্কটি একইসঙ্গে মানুষের সমাবেশ এবং আনন্দ উপভোগের এক প্রধান কেন্দ্র।
তবে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা হোয়াইট হাউসের বিশ্লেষকরা চীনের এই জাহাজ শিল্পের প্রাণকেন্দ্রকে দেখছেন ক্রমবর্ধমান এক হুমকি হিসেবে।
গত দুই দশকে চীন জাহাজ নির্মাণ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, যার সুফলও তারা পাচ্ছে হাতেনাতে। চলতি বছর বিশ্বের ৬০ শতাংশেরও বেশি জাহাজ নির্মাণের অর্ডার গেছে চীনা শিপইয়ার্ডগুলোতে। কারণ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে দ্রুতগতিতে জাহাজ নির্মাণে চীন এখন বিশ্বে সবার শীর্ষে।
লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর মেরিটাইম বিশেষজ্ঞ নিক চাইল্ডস এর মতে, 'চীনা জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের মোট সক্ষমতার প্রায় ২০০ গুণ।'
এই দাপট শুধু বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই নয়, তাদের নৌবাহিনীর ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির। তাদের পরিচালিত যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ২৩৪টি, যেখানে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ২১৯টি।

সমুদ্রের অবদান চীনের দ্রুতগতির উত্থানের পেছনে অনস্বীকার্য। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই অর্থনীতির দেশটিতে রয়েছে পৃথিবীর ১০টি ব্যস্ততম বন্দরের সাতটি, যা বৈশ্বিক সরবরাহ রুটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই এর উপকূলীয় শহরগুলো অভাবনীয় সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জাহাজগুলোর সামরিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চীন নিঃসন্দেহে সমুদ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।
এই লক্ষ্য অর্জনের কতটা কাছাকাছি তারা পৌঁছেছে, তা হয়তো আগামী দিনগুলোতে একটি বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে উন্মোচিত হবে। এই অনুষ্ঠানে শি জিনপিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে আতিথ্য দেবেন, যা নিঃসন্দেহে তাদের বর্জনকারী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জিং বার্তা।ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, হাইপারসনিক অস্ত্র এবং ডুবো ড্রোন প্রদর্শিত হবে।
নিক চাইল্ডস বলেন, 'মার্কিন নৌবাহিনীর এখনো উল্লেখযোগ্য সুবিধা থাকলেও, চীনের সঙ্গে তাদের সক্ষমতার ব্যবধান কমে আসছে এবং এর জবাব খুঁজে পেতে তারা হিমশিম খাচ্ছে।কারণ গত কয়েক দশকে তাদের জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।'
তবে এই পরিস্থিতি ঠিক করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মার্কিন জাহাজ নির্মাণকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও আমেরিকার সামুদ্রিক শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনতে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
যদিও নিক মনে করেন, এটি 'খুবই কঠিন কাজ' হবে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চীনের চারটি বৃহত্তম শিপইয়ার্ড–ডালিয়ান, গুয়াংজু, জিয়াংনান এবং হুদং-ঝংহুয়া মোট ৫,৫০,০০০ টনের সম্মিলিত স্থানচ্যুতি ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৯টি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেছে।
যুদ্ধজাহাজের সংখ্যার দিক থেকে চীনের নৌবাহিনী বিশ্বের বৃহত্তম হলেও, মার্কিন নৌবহরের সামগ্রিক টনেজ বেশি এবং এটি এখনো অনেক বেশি শক্তিশালী, কারণ তাদের রয়েছে আরও অনেক বড় আকারের বিমানবাহী রণতরী। তবে বেইজিং দ্রুত এই ব্যবধান কমিয়ে আনছে।

যদিও চীনের নৌবাহিনীর উত্থানের এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। বেইজিংয়ের হাতে বেশি জাহাজ থাকলেও, তাদের মাত্র দুটি কার্যকর বিমানবাহী রণতরী রয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তাদের ডুবোজাহাজের সংখ্যা অনেক কম। কিছু বিশ্লেষকের মতে, চীনের ডুবোজাহাজগুলো আমেরিকার মতো অত্যাধুনিক নয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রযুক্তিতে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই এগিয়ে থাকার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এছাড়াও, চীনা ডুবোজাহাজগুলো মূলত অগভীর দক্ষিণ চীন সাগরের জন্য তৈরি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের 'ক্যাট-এন্ড-মাউস' খেলা ইতিমধ্যেই চলছে। আপাতত, চীনের পক্ষে নিজেদের উপকূলরেখা থেকে বহু দূরে যাত্রা করার ক্ষমতা সীমিত।
তবে এই পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে।বিবিসি ভেরিফাই কর্তৃক চীনের দক্ষিণ চীন সাগর সংলগ্ন হাইনান প্রদেশের উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, বেইজিং তাদের নৌঘাঁটি সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অর্থ বিনিয়োগ করছে।ইউলিন নৌঘাঁটিতে পাঁচটি নতুন পিয়ার (ঘাটা) দেখা গেছে, যা গত পাঁচ বছরে নির্মিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, চীন তাদের বৃহত্তম সব ডুবোজাহাজ, জিন-ক্লাস (বা টাইপ ০৯৪), এই বন্দরে মোতায়েন করার পরিকল্পনা করছে। এই নতুন ডুবোজাহাজগুলো প্রতিটি ১২টি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
চীনা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কুচকাওয়াজের মহড়ার ছবি ও ফুটেজ অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহের সামরিক কুচকাওয়াজে অন্তত দুই ধরনের নতুন মনুষ্যবিহীন ডুবো ড্রোন প্রদর্শিত হবে, যা দেখতে বড় টর্পেডোর মতো। এগুলো চীনকে গভীর জলের নিচে নজরদারি চালাতে এবং নিজেদের নৌবাহিনীর ঝুঁকি না নিয়ে অন্যান্য ডুবোজাহাজ বা এমনকি সমুদ্রের নিচের তারগুলোও শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
যেখানে চীনের একটি অনস্বীকার্য সুবিধা রয়েছে, তা হলো শিপইয়ার্ডগুলোর দ্বৈত ব্যবহার। বাণিজ্যিক উৎপাদনে সহায়তা করে এমন অনেক শিপইয়ার্ড নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ উৎপাদনেও সাহায্য করতে পারে।
সিএসআইএস এর চায়না পাওয়ার প্রজেক্ট এর ম্যাথিউ ফুনাইওল বলেন, 'যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে, যদি আপনার এমন শিপইয়ার্ড থাকে যা দ্রুত নতুন জাহাজ তৈরি করতে পারে, তবে এটি একটি বিশাল কৌশলগত সুবিধা।বাণিজ্যিক জাহাজগুলো যে কোনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য ইত্যাদি পরিবহন করতে পারে। এটি ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র এমন এক অবস্থানে থাকবে যেখানে তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রচেষ্টা টিকিয়ে রাখতে পারবে না।'
যদিও এটি একটি সরল প্রশ্নে এসে দাঁড়ায়, 'কে দ্রুত এবং সহজে বেশি সম্পদ (জাহাজ) জলে নামাতে পারে?'
এই মুহূর্তে উত্তর হলো, চীন।

তবে এখানে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মেরিটাইম স্ট্র্যাটেজি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক হু বো। তিনি বলেন, 'অন্যান্য দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার, বিশেষ করে সামরিকভাবে, আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।' তার বার্তা হলো, চীন বড় জাহাজ তৈরি করছে কারণ তারা তা করতে সক্ষম, বিশ্ব দখল করার জন্য নয়।
যদিও বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক দ্বীপ তাইওয়ান এর সঙ্গে 'পুনরায় একত্রিত' হওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি। অধ্যাপক হু বো বলেন, 'তাইওয়ানকে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা চীনের ইতিমধ্যেই রয়েছে, কিন্তু চীন তা করছে না কারণ আমাদের ধৈর্য আছে। চীন শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনের সম্ভাবনা কখনোই ত্যাগ করেনি। আমরা অপেক্ষা করতে পারি।'
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, তাইওয়ানের ওপর যেকোনো আক্রমণ একটি বৃহত্তর যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাইওয়ানকে আত্মরক্ষায় সহায়তা করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করতে ওয়াশিংটন আইনত বাধ্য। চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ সতর্ক করে বলেছেন যে চীন তাইওয়ানের জন্য একটি 'আসন্ন' হুমকি তৈরি করেছে, এবং এশিয়ার দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে ও যুদ্ধ প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
সুতরাং অধ্যাপক হু বোর আশ্বাস সত্ত্বেও, এই বিষয়টি উপেক্ষা করা কঠিন যে চীনের যুদ্ধজাহাজগুলো দেশের উপকূল থেকে আরও দূরে যাত্রা শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারিতে, তাদের তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলরেখা প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেছে, যেখানে তারা নজিরবিহীন সরাসরি গোলাগুলির মহড়া চালিয়েছে।
সম্প্রতি চীনা বিমানবাহী রণতরীগুলো জাপানের কাছে নৌ মহড়া চালিয়েছে, যা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে–যদিও এটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল, তবে এই পদক্ষেপ ছিল নজিরবিহীন।

বেইজিং যখন প্রশান্ত মহাসাগরে তার শক্তি প্রদর্শনের প্রচেষ্টায় আরও সাহসী হয়ে উঠছে, তখন তাইওয়ান থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চীনের প্রতিবেশীরা উদ্বিগ্ন যে, তাদের বিখ্যাত মন্ত্র 'শক্তি গোপন করো এবং সময়ের অপেক্ষা করো' কার্যকর হচ্ছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের জন্য মূল প্রশ্ন হলো, চীনের যুদ্ধবহর কতদূর পর্যন্ত যাত্রা করতে পারে এবং বেইজিং তার উপকূল থেকে কতটা দূরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।নিক চাইল্ডস বলেন, 'তারা কখন তাদের সীমানা অতিক্রম করে আরও দূরে, যেমন, ভারত মহাসাগর এবং তার বাইরেও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, তা দেখার বিষয়।'
তিনি বলেন, 'তাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, তবে তারা অবশ্যই নিজেদের সীমা প্রসারিত করছে।'