Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Wednesday
September 03, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
WEDNESDAY, SEPTEMBER 03, 2025
মাদার মেরি কামস টু মি—অরুন্ধতীর পালিয়ে ফেরা শৈশবের গল্প

ইজেল

অরুন্ধতী রায়
01 September, 2025, 10:05 pm
Last modified: 01 September, 2025, 10:28 pm

Related News

  • ঢাকায় অরুন্ধতীর যেভাবে আসা…
  • আল জাজিরার বিশ্লেষণ: ভারত, রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য কতটা বড়
  • সামরিক কুচকাওয়াজে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনসহ আরও কী কী নতুন অস্ত্র প্রদর্শন করল চীন?
  • বৃষ্টির তাণ্ডবে দিল্লির শহরতলিতে তীব্র যানজট, ৮ ঘণ্টা আটকে ছিল যানবাহন
  • অরুন্ধতী রায়: কিছু সাহসী মানুষের কারণে এখনো অন্ধকারে জোনাকির আলো দেখতে পারি 

মাদার মেরি কামস টু মি—অরুন্ধতীর পালিয়ে ফেরা শৈশবের গল্প

আমাদের যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, এই নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। নানি খুব বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু তাকে দেখে ভয় করত। তার তীর্যক কর্নিয়া ছিল এবং তিনি সানগ্লাস পড়ে চোখ ঢেকে রাখতেন। আমার মনে পড়ে, মা, ভাই আর আমি হাত ধরাধরি করে শহরের মধ্যে আতঙ্কে ছোটাছুটি করছি কোনো আইনজীবী খুঁজে বের করার চেষ্টায়। আমার স্মৃতি অনুযায়ী, তখন রাত আর রাস্তা অন্ধকার।
অরুন্ধতী রায়
01 September, 2025, 10:05 pm
Last modified: 01 September, 2025, 10:28 pm
মায়ের সঙ্গে অরুন্ধতী রায় ও ভাই, ১৯৬৩।

দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে অরুন্ধতী রায় উপন্যাস লিখেছেন মাত্র দুটি; যার একটি বুকার প্রাইজজয়ী-বাদবাকি লেখার বড় অংশজুড়ে রয়েছে প্রবন্ধ। তবে স্মৃতিচারণা লিখেছেন এই প্রথম। মা মেরি রায়কে নিয়ে লেখা 'মাদার মেরি কামস টু মি' বইটিতে উঠে এসেছে অরুন্ধতীর শৈশব, মায়ের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন আবার কখনো তার প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার কথা। দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বইটির অংশবিশেষ অনূদিত হলো বাংলায়।

মা আসলে শিক্ষক হতে চাইতেন। সেই যোগ্যতাও তার ছিল। কিন্তু বিয়ের পর সেটা আর হয়নি। আমার বাবা তখন আসামের এক প্রত্যন্ত চা-বাগানে চাকরি করেন, সহকারী ম্যানেজার। বাবার সঙ্গে সংসার করতে করতে মায়ের সেই স্বপ্ন মরে গিয়েছিল। পরে যখন বুঝলেন নির্জন চা এস্টেটে কাজ করা অধিকাংশ তরুণের মতোই বাবাও ভীষণ মদে আসক্ত-তখন তার ভেতরের স্বপ্ন আবার জেগে উঠেছিল, তবে সেটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো।

তারপর যুদ্ধ শুরু হলো। ১৯৬২ সালের অক্টোবর। ভারত-চীন যুদ্ধ সীমান্ত এলাকার নারী-শিশুদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। আমরা কলকাতায় চলে এলাম। সেখানে এসে মা ঘোষণা দিলেন, তিনি আর আসামে ফিরে যাবেন না। কলকাতা থেকে আমরা সারা দেশ ঘুরে একদম দক্ষিণে উটি বা উটাকামুন্ডে পৌঁছালাম, তামিলনাড়ুর উটি নামের পাহাড়ি শহরে। আমার ভাই, এল কে সি-ললিত কুমার ক্রিস্টোফার রায়ের বয়স তখন সাড়ে চার বছর, আর আমার তিন বছর হতে আরও এক মাস বাকি। এরপর বয়স বিশের কোঠায় ঠেকবার আগপর্যন্ত বাবার সঙ্গে আমাদের আর দেখা বা যোগাযোগ হয়নি। 

উটিতে আমরা থাকতাম এক হলিডে কটেজে। তবে পুরোটা নয়, অর্ধেকটায়। কটেজটা ছিল আমাদের নানার। তিনি ব্রিটিশ সরকারের দিল্লির একজন বড় কর্তা হিসেবে চাকরি থেকে অবসরে যান ইম্পেরিয়াল এনটোমোলজিস্ট পদে থেকে।

নানা আর নানির মধ্যে বহুদিন ধরে সম্পর্ক ছিল না। নিজের সন্তানদের সঙ্গেও তিনি সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আমি জন্মাবার বছরই তিনি মারা যান।

কীভাবে আমরা সেই কটেজে ঢুকেছিলাম, আমি ঠিক জানি না। হয়তো পাশের ভাড়াটে মহিলার কাছে চাবি ছিল। আবার হতে পারে, আমরা দরজা ভেঙেই ঢুকেছিলাম।

কটেজটা ছিল অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। মেঝেতে ফাটা সিমেন্ট, ছাদে অ্যাসবেস্টস। একটা পাতলা প্লাইউডের দেয়াল পাশের ঘর থেকে আমাদের অংশকে আলাদা করেছিল।

সেখানে থাকতেন এক বুড়ি ইংরেজ মহিলা। নাম মিসেস প্যাটমোর। তার চুল একেবারে উঁচু করে ফোলা স্টাইলে বাঁধা থাকত। দেখে মনে হতো, ভেতরে যেন কিছু লুকানো আছে। আমি আর আমার ভাই ভাবতাম ভীমরুলের বাসা।

রাতে ঘুমের মধ্যে তিনি চিৎকার করতেন, গোঙাতেন। ভাড়া দিতেন কি না, জানি না। কার কাছে দেবেন, সেটাই হয়তো তিনি জানতেন না। আমরা অবশ্য কোনো ভাড়া দিতাম না। আমরা ভাড়াটে নই। আমরা ছিলাম দখলদার। পলাতক।

সেখানে বড় বড় কাঠের ট্রাঙ্ক ছিল আর সেই ট্রাঙ্ক ভরা ছিল মৃত ইম্পেরিয়াল এনটোমোলজিস্ট ভদ্রলোকের ঝকঝকে পোশাকে, সিল্কের টাই, ড্রেস শার্ট, থ্রি পিস স্যুট।

একদিন একটা পুরোনো বিস্কুটের টিন খুঁজে পেলাম। ভেতরে শুধু কাফলিংক। 

পরে বড় হয়ে শুনলাম নানার সব কাহিনি। তিনি ছিলেন ভীষণ আড়ম্বরপ্রিয় মানুষ। হলিউডের এক স্টুডিওতে গিয়ে নিজের ছবি তুলেছিলেন। তার একটা হিংস্র দিকও ছিল, সন্তানদের বেত দিয়ে পেটাতেন, হুটহাট ঘর থেকে বের করে দিতেন। একদিন পিতলের ফুলদানি ছুড়ে নানির মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন।

মা বলতেন, 'এই মানুষটার হাত থেকে পালাতেই আমি বিয়ে করি। যেই লোকটা প্রথম বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল তাকেই।'

উটিতে পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় একটা স্কুলে মা চাকরি পেলেন। স্কুলের নাম ব্রিক্স।

সেই সময় উটিতে অনেক স্কুল ছিল। অনেক স্কুল আবার চালাতেন ব্রিটিশ মিশনারিরা, যারা স্বাধীনতার পরও ভারত ছেড়ে যাননি।

মা তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললেন, বিশেষ করে লাশিংটন নামের এক স্কুলের শিক্ষকদের সাথে। স্কুলটা ছিল সাদা চামড়ার বাচ্চাদের জন্য, ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ মিশনারিদের সন্তানেরা সেখানে পড়ত। মা তাদের রাজি করালেন, অবসরে যেন তিনি তাদের ক্লাসে বসতে পারেন। তারা অনুমতি দিল। মা ক্ষুধার্ত মানুষের মতো তাদের নতুন নতুন পড়ানোর কৌশল শিখে নিলেন।

তবে একটা ব্যাপার তার মনে খচখচ করত। ওই বিদেশিরা ভদ্র, দয়ালু, হাসিখুশি-সবই ঠিক। কিন্তু ভারত আর ভারতীয়দের নিয়ে তাদের যে আচরণ, সেখানে অদ্ভুত রকমের বর্ণবাদও লুকিয়ে থাকত।

আমাদের পালিয়ে বেড়ানো জীবনের কয়েক মাসের মধ্যেই, আমার নানি (এনটোমোলজিস্ট ভদ্রলোকের স্ত্রী) আর তার বড় ছেলে-আমার মায়ের বড় ভাই জি আইজ্যাক কেরালা থেকে এসে আমাদের খুঁজে বের করল। আমি তাদের আগে কখনো দেখিনি। তারা আমার মাকে শাসিয়ে বলল, ট্রাভানকোর ক্রিশ্চিয়ান উত্তরাধিকার আইনের কারণে মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। আর আমাদের এখনই ঘর ছাড়তে হবে।

আমাদের মামা জি আইজ্যাক তখন বুঝতে পারেননি, তার ছোট বোনকে তার বাবার কটেজ থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করে সে একদিন নিজেই এক বিপদের মধ্যে পড়বে। বছর কয়েক পরে এই ট্রাভানকোর ক্রিশ্চিয়ান উত্তরাধিকার আইনের বিরুদ্ধে মা লড়াই করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল কেরালায় তার পিতার সম্পত্তির সমান অংশ দাবি করা। কিন্তু এর আগপর্যন্ত তিনি এই লজ্জার, আতঙ্কের স্মৃতিটিকে নিজের মতো লালন করতেন, যেন তা কোনো অমূল্য পারিবারিক সম্পদ। এবং একদিক থেকে এটি হয়তো তাই ছিল। 

আমাদের যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, এই নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। নানি খুব বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু তাকে দেখে ভয় করত। তার তীর্যক কর্নিয়া ছিল এবং তিনি সানগ্লাস পড়ে চোখ ঢেকে রাখতেন। আমার মনে পড়ে, মা, ভাই আর আমি হাত ধরাধরি করে শহরের মধ্যে আতঙ্কে ছোটাছুটি করছি কোনো আইনজীবী খুঁজে বের করার চেষ্টায়। আমার স্মৃতি অনুযায়ী, তখন রাত আর রাস্তা অন্ধকার। কিন্তু সেটা হবার কথা না। কারণ, আমরা শেষমেষ একজন আইনজীবী খুঁজে পেলাম, যিনি বললেন ট্রাভাঙ্কোর আইন শুধু কেরালার জন্য প্রযোজ্য, তামিলনাড়ুতে নয় এবং এমনকি আমাদের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসাদেরও অধিকার আছে। তিনি বললেন কেউ যদি আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, আমরা পুলিশ ডাকতে পারি। আমরা কটেজে ফিরে এলাম, কাঁপতে কাঁপতে, কিন্তু বিজয়ীর বেশে।

আইনি জটিলতায় জয়লাভের পরে আমরা কটেজে ঢুকে নিজের জন্য একটু জায়গা বানালাম। মা ইম্পেরিয়াল এনটোমোলজিস্ট ভদ্রলোকের সব স্যুট আর কাফলিঙ্কস বাজারের পাশে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ড্রাইভারদের দিয়ে দিলেন। কয়েক দিনের জন্য উটি যেন এক অদ্ভুত ফ্যাশন শহরে পরিণত হয়ে গেল, পৃথিবীর সবচেয়ে ফ্যাশনেবল ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ছিল সেখানে।

আমাদের সেই শান্তিটুকু ছিল ক্ষণস্থায়ী। উটির ঠান্ডা, ভেজা আবহাওয়া মায়ের হাঁপানি আরও বাড়িয়ে দিল।

মা একটা মোটা গোলাপি রঙের কম্বল গায়ে দিয়ে লোহার খাটে শুয়ে থাকতেন আর লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলতেন-দিনের পর দিন। আমরা ভেবেছিলাম তিনি হয়তো মারা যাচ্ছেন। আমরা মায়ের ঘরে ঢুকে মায়ের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি, মা এটা মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি আমাদের ঘর থেকে বের করে দিতেন। কাজেই আমি আর আমার ভাই তাকিয়ে থাকার জন্য অন্য কিছু খুঁজতাম। 

একটা তিন কোনা কম্পাউন্ড ছিল, এর এক কোণে একটা নিচু, নড়বড়ে গেট ধরে আমরা ঝুলতাম আর দোল খেতাম। দেখতাম হানিমুনে আসা নবদম্পতিরা হেঁটে যাচ্ছে, হাত ধরাধরি করে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে প্রেম করতে। মাঝে মাঝে তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলত, মিষ্টি দিত, চিনাবাদাম দিত। একবার একজন আমাদের একটি ক্যাটাপল্ট দিল। আমরা দিনরাত নিশানা ঠিক করার চেষ্টা করতাম। অচেনা লোকদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে যেতাম।

একবার একজন খপ করে আমার হাত ধরে আমাকে বাড়ি ফেরত দিয়ে গেল। সে মাকে কঠিন সুরে বলল, আপনার মেয়ের চিকেনপক্স হয়েছে। আমাকে আমার পেটের ফোসকাটা দেখাতে বলল, যেটা আমি আরও অনেককেই দেখিয়েছি, যারা যারা দেখতে চেয়েছে। মা খুব রেগে গেলেন। লোকটা চলে যাওয়ার পর আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন। আর কখনো যেন আমি আমার জামা উঁচু না করি, পেট না দেখাই; বিশেষ করে অচেনা পুরুষদের সামনে। 

মায়ের মেজাজ হয়ে গেল খিটখিটে; হয়তো অসুখের জন্য, হয়তো ওষুধের জন্য এবং প্রায়ই আমাদের মারতেন। যখন এমন হতো, আমার ভাই পালিয়ে যেত, আর অন্ধকার না হলে বাড়ি ফিরত না। সে খুব শান্ত ছেলে ছিল, কখনো কাঁদত না। মন খারাপ হলে ডাইনিং টেবিলের ওপর মাথা রেখে ভান করত ঘুমিয়ে গেছে। আর যখন খুশি হতো, যা খুব কমই হতো-আমার চারপাশে নাচত, বাতাসে ঘুষি মারত, আর বলত সে কেসিয়াস ক্লে। আমি অবশ্য জানতাম না, এই কেসিয়াস ক্লেটা কে, তবে সে কীভাবে জানি চিনত। হয়তো বাবা বলেছিল। 

উটির বছরগুলো আমার চেয়ে তার জন্য বেশি কঠিন ছিল। তার সব মনে ছিল। এর চেয়ে ঢের ভালো একটা জীবনের স্মৃতি তার ছিল-বাবা, চা-বাগানের বড় বাড়ি আর ভালোবাসা। আমি ভাগ্যবান, আমার মনে রাখার মতো এমন কোনো সুখস্মৃতি ছিল না।

আমার ভাই আমার আগেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। সে কয়েক মাসের জন্য লাশিংটনে পড়েছিল, সেই সাদা চামড়াদের স্কুলে (হয়তো মিশনারিদের পক্ষ থেকে মায়ের জন্য কোনো সুবিধা ছিল)।

কিন্তু যখন সে আমাদের মতো স্থানীয় ছেলেমেয়েদের 'ওই ভারতীয় বাচ্চারা' বলা শুরু করল, মা তাকে নিয়ে এলেন আর ব্রিকস স্কুলে ভর্তি করালেন, যেখানে তিনি নিজেই পড়াতেন।

যখন মায়ের হাঁপানির টান উঠত, মা সবজি আর অন্যান্য জিনিসের একটি লিস্ট লিখে বাস্কেটে ভরে আমাদের শহরে পাঠাতেন। উটি তখন এক ছোট, নিরাপদ শহর। ট্রাফিক কম। পুলিশ আমাদের চেনে। দোকানদারেরা খুবই ভালো, কখনো কখনো বাকিতেও সদাই দিত।

সবচেয়ে ভদ্র ছিলেন কুরুসম্মাল। এই ভদ্রমহিলা নিটিং শপে কাজ করতেন। আমাদের জন্য দুটি পোলো-নেক সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন। ভাইয়ের জন্য বটল-গ্রিন রঙের। আমার জন্য প্লাম।

যখন মা কয়েক সপ্তাহ পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন, তখন কুরুসম্মাল আমাদের সঙ্গে থাকতে এল। আমাদের উদ্দাম জীবনের সেখানেই ইতি ঘটল। কুরুসম্মালই আমাদের শেখাল ভালোবাসা কী।নির্ভরযোগ্যতা কী। জড়িয়ে ধরার অনুভূতি কী। সে আমাদের জন্য রান্না করত এবং উটির হাড় হিম ঠান্ডায় বাইরে, বড় পাত্রে কাঠের আগুনে ফোটানো পানি দিয়ে গোসল করাত। আজও, ভাই আর আমি প্রায় ফুটন্ত পানি ছাড়া গোসল করতে পারি না। 

গোসলের আগে সে আমাদের চুল থেকে উকুন বেছে দিত আর দেখাত কীভাবে ওগুলোকে মারতে হয়। আমি তো উকুন মারার কাজটা ভীষণ উপভোগ করতাম। নখ দিয়ে ওগুলোকে যখন টিপে মারতাম, তখন এক অদ্ভুত শব্দ হতো, যেটা শুনে আরাম লাগত। কুরুসম্মাল শুধু যে ঝড়ের গতিতে বুনতে পারত, তা-ই না, সে অসাধারণ রান্নাও করত। বিশেষ কোনো উপকরণ না থাকলেও সে কীভাবে যেন তা থেকেই সুস্বাদু সব খাবার বানিয়ে ফেলত। শুধু লবণ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত বেড়ে দিলেও খেতে এত ভালো লাগত। কুরুসম্মালের নাম তামিল অর্থ 'ক্রসের মা'। তার স্বামীর নাম ছিল ইয়েসুরাতনাম ('যিশুর রত্ন', 'রত্নের রত্ন')। তার গলায় গলগন্ড ছিল, সেটা সে উলের মাফলার দিয়ে ঢেকে রাখত। তার গায়ে আমাদের মতোই কাঠের ধোঁয়ার গন্ধে ভরা থাকত। 

শেষমেষ মা এত অসুস্থ হয়ে গেলেন যে কাজ করতে পারছিলেন না। স্টেরয়েডও সাহায্য করছিল না। টাকা শেষ হয়ে এল। ভাই আর আমি অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছিলাম, আমাদের প্রাথমিক স্টেজের টিউবারকুলোসিস ধরা পড়ল।

কয়েক মাসের কঠিন লড়াইয়ের পর মা হাল ছেড়ে দিলেন। আত্মসম্মান ত্যাগ করে কেরালায় ফিরলেন আমাদের নানির গ্রামে, আয়েমেনেম। আর কোনো উপায় বাকি ছিল না।

ট্রেন যখন তামিলনাড়ু থেকে কেরালার সীমানা পার হলো, জমি রঙ বদলাল-বাদামি থেকে সবুজ। সব কিছু, বৈদ্যুতিক খুঁটি পর্যন্ত, গাছপালা আর লতায় ঢেকে গেছে। সব ঝকঝক করছে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে যাদের দেখা যাচ্ছিল, পুরুষ মহিলা প্রায় সবাই সাদা পরে, হাতে কালো ছাতা।

আমার হৃদয় গেয়ে উঠল।

তারপর বিষণ্নতায় ডুবে গেল।

আমরা আয়েমেনেমে পৌঁছালাম বিনা আমন্ত্রণের অতিথি হিসেবে, স্বাগতহীন।

যে বাড়ির দোরগোড়ায় আমরা অদৃশ্য এক ভিক্ষার পাত্র নিয়ে হাজির হলাম, সেটা ছিল নানির বড় বোন, মিস কুরিয়েনের। তার বয়স তখন ষাটের ঘরে। 

পাতলা, ঢেউ খেলানো ধূসর চুল ছোট করে কেটে রাখা, যা তখন পেজবয় স্টাইল বলা হতো।

স্টার্চ করা, কাগজের মতো সরু শাড়ি পরতেন, বড়, ঢিলা ব্লাউজসমেত।

মিস কুরিয়েন ছিল সময়ের বেশির ভাগ নারীর চেয়ে অনেক প্রগতিশীল।

বিয়ে করেননি। তার ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি ছিল। শ্রীলঙ্কার (যার পূর্বনাম সিলন) কলেজে পড়িয়েছেনও।

তিনি মাকে আশ্বাস দিলেন, যত দিন না মা একটা চাকরি পাচ্ছেন, তত দিন আমরা এখানে থাকতে পারব। মিস কুরিয়েন নিজেকে একজন ভালো খ্রিষ্টান মনে করতেন এবং আমাদের থাকতে দিলেন। কিন্তু তার যে আমাদের অপছন্দ, সেটা তিনি লুকালেন না। তিনি আমাদের এড়িয়ে চলতেন। অন্য আত্মীয়দের বাচ্চাদের দিকে তার সব স্নেহ উজাড় করে দিতেন।

তাদের উপহার দিতেন। পিয়ানো বাজাতেন। কাঁপা কণ্ঠে গান গেয়ে শোনাতেন।

তিনি স্পষ্ট করে জানালেন, আমাদের পছন্দ করেন না। (এ জন্য আমরাও তাকে পছন্দ করতাম না।)

তবু, সত্যি বলতে, সবচেয়ে দরকারের সময় তিনিই আশ্রয় দিয়েছিলেন, অন্তত আমাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল।

নানিও তার সঙ্গে থাকতেন। তিনি তখন প্রায় অন্ধ। তবু কালো সানগ্লাস পরে থাকতেন। রাতের বেলাতেও। তার মাথার মাঝ বরাবর একটা দাগ ছিল, পিতলের ফুলদানির আঘাতের দাগ। মাঝে মাঝে আমাকে সেটা আঙুল বুলিয়ে দেখতে দিতেন।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বেহালা বাজাতেন। তার স্বামী-ইম্পেরিয়াল এনটোমোলজিস্ট-যখন ভিয়েনায় পোস্টেড ছিলেন, তখন তিনি সংগীত শিখেছিলেন। তার শিক্ষক একদিন বলেছিলেন, তিনি কনসার্ট-লেভেলের বেহালাবাদক হতে পারেন। তার স্বামী সঙ্গে সঙ্গে পাঠ বন্ধ করে দিলেন। রাগে তার প্রথম বেহালাটা ভেঙে ফেললেন।

আমি তখন খুব ছোট। তিনি কতটা ভালো বাজাতেন, সেটা বোঝার বয়স তখনো হয়নি।

কিন্তু আয়েমেনেমে সন্ধ্যা নামলে, ঝিঁঝিঁ পোকারা ডাকাডাকি শুরু করলে, তার সুর সন্ধ্যাকে আর রাতকে আরও বিষণ্ন করে তুলত।

আমার মামা জি আইজ্যাক মূল বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া একটা অ্যানেক্সে থাকতেন। প্রথমে আমি তাকে ভীষণ ভয় পেতাম। আমার কাছে তিনি ছিলেন উটিতে আমাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা লম্বা, মোটা, রাগী লোকটা। কিন্তু আয়েমেনেমে এসে ধীরে ধীরে তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তিনি আমাকে আর আমার ভাইকে প্রায়ই নদীতে নিয়ে যেতেন। সেখানেই আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন।

জি আইজ্যাক ছিলেন ভারতের প্রথম দিককার রোডস স্কলারদের একজন। তার পড়ার বিষয় ছিল গ্রিক আর রোমান পুরাণ। খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ বলতেন, মদ আর উল্লাসেরও আবার দেবতা আছে, ব্যাপারটা কি দারুণ না? সবাই তখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। তারপর তিনি গল্প শুরু করতেন ডায়োনিসাসের বা সেদিনের পছন্দের দেবতার।

কয়েক বছর মাদ্রাজের এক কলেজে পড়ানোর পর হঠাৎ করেই তিনি চাকরি ছেড়ে দিলেন। সবাই ভেবেছিল, ভালোমতো চলছিল, হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? তিনি বললেন, শেকড়ের কাছে ফিরতে হবে। ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে আচার, জ্যাম আর কারি পাউডারের কারখানা খুললেন। নাম দিলেন মালাবার কোস্ট প্রোডাক্টস। কারখানাটা চলত কোট্টায়ামের সেই পুরোনো বাড়ি থেকে, যেখানে একসময় ইম্পেরিয়াল এনটোমোলজিস্ট থাকতেন। (পরে এই বাড়িটাই মামলার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়, যখন মা ট্রাভানকোর ক্রিশ্চিয়ান সাকসেশন অ্যাক্টকে চ্যালেঞ্জ করেন।)

মজার ব্যাপার হলো, উত্তরাধিকার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একেবারে মার্ক্সবাদী। বলতেন, চাকরি ছাড়িনি, ত্যাগ করেছি। ছোট শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া, স্থানীয়দের কর্মসংস্থান বাড়ানো-এই ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু তার এই দর্শন নিয়ে সুইডিশ স্ত্রী সিসিলিয়া একেবারে বিরক্ত হয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত তিন ছেলেকে নিয়ে ফিরে গেলেন সুইডেনে।

এভাবেই নানা রকম বিচিত্র, অদ্ভুত, পড়ালেখা করা কিন্তু জীবনে হেরে যাওয়া মানুষদের এক অদ্ভুত মিলন ঘটেছিল আয়েমেনেম নামের ছোট্ট গ্রামে।

এখানে জীবনটা ছিল একেবারে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকার মতো; যেকোনো মুহূর্তে কেউ ঠেলে ফেলে দিতে পারে। রান্নার লোক কোচু মারিয়াও আমাকে বলত, আমাদের এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। সে বিড়বিড় করত, মুখ ভার করে বলত, বাবাহীন বাচ্চারা নাকি ভদ্রঘরের লোকেদের সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকে, এটা নাকি লজ্জার ব্যাপার।

কয়েক দিন পরপরই কসমোপলিটানরা ঝগড়া শুরু করত। তাদের ঝগড়া মানে পুরো বাড়িটাই যেন কেঁপে উঠত। থালাবাসন ভেঙে যেত, দরজা পর্যন্ত ভাঙা পড়ত।

চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হলেই আমি পালিয়ে যেতাম। নদী ছিল আমার আশ্রয়। জীবনের সব ভুলভ্রান্তি, সব কষ্টকে যেন নদী মুছে দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর ধারে কাটাতাম। মাছ, কেঁচো, পাখি, গাছপালার সঙ্গে যেন নাম ধরে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে, এমনকি কিছু বয়স্ক মানুষের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। খুব দ্রুত মালয়ালম শিখে ফেললাম, অল্প দিনের মধ্যেই সবার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারতাম।

তারা যেন একেবারে অন্য এক জগৎ থেকে এসেছে। কেউ ধানখেতে কাজ করে, কেউ রাবারবাগানে, কেউ বা নারকেলগাছে উঠে ফল পাড়ে, আবার কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কাদা আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরে তাদের বসবাস। অনেকেই এমন জাতের ছিল যাদের 'অস্পৃশ্য' বলা হতো। তখন এসব ভয়ংকর ব্যাপার সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। আয়েমেনেমের বাড়ির মানুষজন নিজেদের ঝগড়াঝাঁটিতেই এত ব্যস্ত ছিল যে আমাকে এসব শেখানোর সময় তাদের হয়নি।

আয়েমেনেমে থাকত এক তরুণ, তবে কাজ করত কোট্টায়ামে, মালাবার কোস্ট প্রোডাক্টসে। সেই হয়ে উঠল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমরা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটাতাম। বাঁশের খণ্ড দিয়ে সে আমার জন্যে বানাল একটা মাছ ধরার ছিপ, তারপর দেখাল, মাটি খুঁড়ে কোথায় পাওয়া যায় সবচেয়ে মোটা কেঁচো, টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। মাছ ধরতে শিখিয়েছে সেই। কীভাবে চুপচাপ স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়, তা-ও সে শিখিয়েছে। আমি যে ছোট্ট মাছগুলো ধরতাম, সেগুলো সে ভেজে দিত, আর আমরা একসঙ্গে খেতাম যেন রাজকীয় ভোজ চলছে।

তার থেকেই জন্ম নিল 'দ্য গড অব স্মল থিংস' উপন্যাসের চরিত্র 'ভেলুতা'-অমুর প্রেমিক।

কয়েক মাসের মধ্যেই আমি আয়েমেনেমের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলাম; একটা দুষ্টু বাচ্চা, যে নদীর দিকে যাওয়া গ্রামের সব লুকানো পথ আর শর্টকাট জানত। আমি বাইরে বেশি থাকতাম, যতটা সম্ভব কম বাড়ি ফিরতাম।

মানুষ নয়, এমন প্রজাতির মধ্যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিল এক ডোরাকাটা দাগওয়ালা কাঠবিড়ালি, যেটা আমার কাঁধে এসে বসত এবং কানে কানে ফিসফিস করত। আমরা সিক্রেট শেয়ার করতাম। সে আমার পোষা কাঠবিড়ালি ছিল না। তার নিজস্ব একটা জীবন ছিল, কিন্তু সে সেটা আমার সঙ্গে ভাগ করতে চেয়েছিল। সে প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে যেত; কারণ, তার নিজস্ব কাজে ব্যস্ততা ছিল। খাবারের সময় সে এসে আমার প্লেটের ওপর বসত এবং আমার খাবার থেকে অল্প একটু খেত। সে সর্বদা সতর্ক, প্রতিটি সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে খুব সচেতন। সে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

আমার মা তার সারা দিনের সহ্য করা ঝগড়া আর অপমানের বোঝা আমার ভাই আর আমার ওপর ঝাড়তেন। অবশ্য আমরাই ছিলাম তার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। তার ক্রোধ, যা আগেই ভয়ানক ছিল, আরও অযৌক্তিক আর নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠল। আমি বুঝতে পারতাম, কিসে তার রাগ হয় আর কিসে তার আনন্দ। এ যেন একটা মাইন ফিল্ডে ম্যাপ ছাড়া হাঁটার মতো। 

যখন মা আমার ওপর রেগে যেতেন, তখন আমার কথার ধরন নকল করে আমাকে অপমান করতেন। তিনি এই নকল করার কাজটা খুবই ভালো করতে পারতেন, শুনে নিজের প্রতি নিজেরই হাসি পেত। মা যখন এমন করতেন, তখনকার প্রতিটি মুহূর্ত আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি। আমি কী পরেছিলাম, সেটাও মনে আছে। মনে হতো যেন তিনি আমাকে আমার আকার অনুযায়ী একটা ছবির বই থেকে ধারালো কাঁচি দিয়ে কেটে বের করেছেন এবং তারপর চিরে ফেলে দিয়েছেন।

প্রথমবারটা করেছিলেন মাদ্রাজ থেকে ফেরার পথে, যেখানে আমরা দুই সপ্তাহ ছিলাম। তার বড় বোন, মিসেস জোসেফ এবং তার স্বামী ছুটিতে থাকবেন, তিনি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মা কি তার তিনটি সন্তানের যত্ন নিতে পারবেন। মা রাজি হলেন। হয়তো মা ভেবেছিলেন যে কমপক্ষে নামমাত্রভাবে হলেও সেখানে থেকে নিজের খরচ তুলতে পারবেন।

আয়েমেনেমের ঝগড়াটে কসমোপলিটানদের মতো নয়, মিসেস জোসেফের সব ঠিকঠাক ছিল; একদম ঠিকঠাক একজন স্বামী, যিনি ভারতীয় এয়ারলাইনসে পাইলট; সন্তান আর একটা বাড়ি, চাকর বাকরসহ। আমি ভাবতাম, মায়ের সাথে তার মধ্যে এমন বড় ফারাক কেন। সে সব বিষয়ে তার ভাইবোনদের তুলনায় সফল। মিসেস জোসেফ দেখতে সুন্দর, তার উচ্চ কণ্ঠস্বর। শাড়িটা সব সময় ইস্তিরি করা, চুলগুলো পরিপাটি, আর হাসিটা টানটান; যেন যার সাথে কথা বলছেন, সে খুব বিশ্বস্ত জেনেই তা করছেন। আমি মাকে দেখতাম, আর তারপর মিসেস জোসেফকে দেখতাম: চেহারা, স্বভাব কোনো কিছুতেই তাদের মিল খুঁজে পেতাম না।

মিসেস জোসেফ ছুটির পর যখন ফিরে এলেন, বোনেরা কোনো না কোনো কারণে ভয়ানক ঝগড়া করল। আমরা পরের দিন বিমান ধরে কেরালায় ফিরলাম। খালার পাইলট স্বামীর কাছে কিছু ফ্রি টিকিট ছিল। আগে আমরা কখনো বিমানে চড়িনি। যখন আমরা বসে গেলাম, আর বড়দের মতো একটা কনভার্সেশন করতে চাইলাম; আমি মায়ের কাছে জানতে চাইলাম, যদি মিসেস জোসেফ সত্যিই মায়ের বোন হয়, তাহলে তিনি এত চিকন কীভাবে?

আমার মা হঠাৎ রেগে গেলেন। আমি অনুভব করলাম আমি যেন নিজের শরীরের ভেতর কুঁকড়ে যাচ্ছি, সিঙ্ক বেয়ে পানি নেমে যাবার মতন। তারপর তিনি বললেন, 'তুমি যখন আমার বয়সী হবে, তোমার সাইজ হবে আমার তিন গুণ।' আমি জানতাম আমি ভয়ানক কিছু বলেছি, কিন্তু ঠিক কী বলেছি, তা বোঝা যাচ্ছিল না। তখন ছোট ছিলাম, 'মোটা' আর 'চিকন' নিয়ে কোনো রায় দেওয়ার বা জাজ করার বয়স হয়নি। কয়েক বছর পরে, যখন বিষয়টা শান্তভাবে ভাবার সাহস পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম, কী কুৎসিত একটা কথা বলেছি, শুনলে যে কারও কষ্ট পাওয়ার কথা।

মায়ের যে স্টেরয়েডগুলো নিতেন, সেগুলো হঠাৎ করে তার ওজন বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার মুখে জন্ম নিয়েছে একটা কোর্টিসন মুন-ফেস। তার সুন্দর, সুশ্রী মুখটা আর দেখা যাচ্ছিল না; ফোলা দুটি গাল আর ডাবল চিনের আড়ালে সেটা হারিয়ে গেছে। তার স্লিম দেখতে বোনের সুন্দর বাড়িতে গিয়ে হয়তো তিনি দুঃখ পাচ্ছিলেন আর হতাশ বোধ করছিলেন। তাঁর সাফল্যে ভরা ক্যারিয়ার তখনো সামনে, কিন্তু তখন তার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না।

একদিন মায়ের চিকন দেখতে বোনকে নিয়ে একটা প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম, সেটা যেন আগুনের ওপর ভিনেগার ঢেলে দেওয়ার মতো হয়ে গেল। মায়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। আমি যে কতটা অসচেতন ছিলাম, তখন বুঝিনি। মা হঠাৎ করেই আমার ছয় বছরের শিশুসুলভ উচ্চারণ নকল করে আমাকে জবাব দিল। নিজের ওপর রাগ হলো।

আজও মনে আছে, সেদিন কী পরেছিলাম। আকাশি নীল রঙের পলকা ডটস দেওয়া একটা জামা। আমার নিখুঁত কাজিনের পুরোনো জামা; ওর চুল ছিল একদম সোজা, আর চোখ ছিল হরিণের মতো বড় বড়।

কিন্তু আমি সেই জামায় ঠিক মানিয়ে যাইনি। আমার হাঁটুতে তখন দাগ, কাটাছেঁড়া-একটা গোটা জীবনের ডায়েরি যেন। বাবা নেই, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; মিনাচিল নদীর পাড়ে অয়েমনেমে আমার এক রংচঙে, অগোছালো, বুনো শৈশবের সাক্ষী সেই হাঁটুজোড়া।

আমি আমার নিখুঁত কাজিনের সঙ্গে একটা কল্পনার প্রতিযোগিতা করেছিলাম-আর সেটা আমি অনায়াসে জিতে গিয়েছিলাম। ওর ছিল একজন পাইলট বাবা। আর ছিল সুন্দর চুল। কিন্তু আমার ছিল একটা সবুজ নদী। (সেই নদীতে মাছ ছিল, ওপরে আকাশ ছিল, সাথে গাছের ছায়া ছিল, আর রাতে থাকত ভাঙা, হলুদ রঙের চাঁদ।) আর ছিল একটা কাঠবিড়ালি।

আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এই স্যান্ডেলের সঙ্গে পা দুটো একদম মানায় না।

তারপর সেই ভয়ংকর প্লেন। ভেতরে ভয়ংকর মানুষজন। বাইরে ভয়ংকর আকাশ। আমি চেয়েছিলাম প্লেনটা ভেঙে পড়ুক। সবাই মরে যাক। আমিও। সবচেয়ে বিরক্ত লাগছিল ওই আদুরে বাচ্চাগুলোর ওপর; যাদের মা-বাবা ওদের চোখে চোখে রাখছে, আদর করছে।

এসব যখন মনে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, হঠাৎ মা আমার দিকে ফিরে বলল, 'আমি তোমার মা, আমি তোমার বাবা, আমি তোমাকে দ্বিগুণ ভালোবাসি।'

তারপর প্লেন ঠিক হয়ে গেল।

আকাশ ঠিক হয়ে গেল।

কিন্তু আমার পা তখনো স্যান্ডেলের ভেতরে অচেনা অতিথির মতো ছিল।

আর, কিছু না-মেটানো হিসাব বাকি রয়ে গেল।

যদি আমি ওর থেকে তিন গুণ বড় হই, তাহলে তো আমার তিনটা সিট লাগবে বসতে।

তিনটা ফ্রি টিকিট।

ডাবল ভালোবাসা।

ট্রিপল সাইজ।

একটা অঙ্কের ক্লাস যেন শুরু হয়ে গেল।

একটা সমাধান খুঁজতে হবে-

ডাবল ভালোবাসাকে ট্রিপল সাইজ দিয়ে ভাগ করে ফ্রি টিকিট দিয়ে গুণ করে সেটাকে হাবিজাবি কথা দিয়ে ভাগ করলে কত হয়?

উত্তর হলো, একটা ঠান্ডা, লোমশ প্রজাপতির মতো কী যেন বসে থাকে বুকের ভেতর।

ভয় পেয়ে থাকা হৃদয়ে।

সেই প্রজাপতিটা ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।

খুব ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটাই কখনো কখনো সবচেয়ে বিপজ্জনক হতে পারে।

আর কখনো যদি না-ও হয়, আমি নিজেই সেটাকে বিপজ্জনক বানিয়ে ফেলি।


অনুবাদ: আইনুন নাহার এষা

Related Topics

টপ নিউজ

অরুন্ধতী রায় / বিস্কুট / বিয়ে / বিদেশি / তামিলনাড়ু / ভারত / চীন / ব্রিটিশ

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • ব্র্যাক ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রেফাত উল্লাহ খান
  • প্রতিষ্ঠাতার পর উত্তরাধিকারীদের হাতে কেন টেকে না বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসা
  • বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্রিজ ব্যাংক’ পরিকল্পনায় সম্মত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
  • বিএনপি কেন জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নেবে: প্রশ্ন রিজভীর
  • ২০১৮ নির্বাচনে হাসিনাকে ব্যালট বাক্স ৫০% ভরে রাখার পরামর্শ দেন সাবেক আইজিপি পাটোয়ারী: মামুন
  • সাবেক ডিবি প্রধান হারুনকে ‘জ্বীন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: মামুন

Related News

  • ঢাকায় অরুন্ধতীর যেভাবে আসা…
  • আল জাজিরার বিশ্লেষণ: ভারত, রাশিয়া ও চীনের বাণিজ্য কতটা বড়
  • সামরিক কুচকাওয়াজে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনসহ আরও কী কী নতুন অস্ত্র প্রদর্শন করল চীন?
  • বৃষ্টির তাণ্ডবে দিল্লির শহরতলিতে তীব্র যানজট, ৮ ঘণ্টা আটকে ছিল যানবাহন
  • অরুন্ধতী রায়: কিছু সাহসী মানুষের কারণে এখনো অন্ধকারে জোনাকির আলো দেখতে পারি 

Most Read

1
বাংলাদেশ

ব্র্যাক ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রেফাত উল্লাহ খান

2
অর্থনীতি

প্রতিষ্ঠাতার পর উত্তরাধিকারীদের হাতে কেন টেকে না বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসা

3
অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্রিজ ব্যাংক’ পরিকল্পনায় সম্মত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

4
বাংলাদেশ

বিএনপি কেন জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নেবে: প্রশ্ন রিজভীর

5
বাংলাদেশ

২০১৮ নির্বাচনে হাসিনাকে ব্যালট বাক্স ৫০% ভরে রাখার পরামর্শ দেন সাবেক আইজিপি পাটোয়ারী: মামুন

6
বাংলাদেশ

সাবেক ডিবি প্রধান হারুনকে ‘জ্বীন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: মামুন

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net