বুনো ঘোড়া কীভাবে মানুষের বাহন হলো, জানাল প্রাচীন ডিএনএ

ঘোড়ার শক্তি মানুষের সমাজকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছে। মানুষের চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, কৃষি এবং যুদ্ধ—সব ক্ষেত্রে এটি এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আমরা জানি, পরবর্তীতে একসময় ঘোড়ার জায়গা ইঞ্জিন নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা কবে এবং কীভাবে এই বুনো প্রাণীকে শান্ত ও মানুষের চড়ার উপযোগী করে তোলে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে। বিজ্ঞানীরা পুরনো দাঁত ও হাড় পরীক্ষা করে এই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু প্রাচীন ডিএনএ নিয়ে করা একটি নতুন গবেষণা আধুনিক ঘোড়ার উদ্ভবের রহস্যের ওপর আলো ফেলেছে। এই গবেষণায় এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনগত পরিবর্তন চিহ্নিত হয়েছে যা ঘোড়ার শরীর ও আচরণকে বদলে দিয়েছে। এর ফলে বুনো ঘোড়ারা শান্ত হয়ে মানুষের চড়ার উপযোগী হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাটি ঘোড়া পোষ মানানোর জটিল গল্পটি তুলে ধরেছে। প্রায় ৭,০০০ বছর আগে থেকে ২০শ শতক পর্যন্ত শত শত ঘোড়ার দেহাবশেষ থেকে সংগৃহীত জিনোম ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষ কীভাবে ঘোড়ার বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে, তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা এমন জিন খুঁজেছেন যা আগে খুব কম ঘোড়ার মধ্যে ছিল, পরে প্রায় সব ঘোড়ার মধ্যে সাধারণ হয়ে যায়। এটি প্রমাণ করে, মানুষ নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত ঘোড়া বেছে নিয়েছিল। তারা দেখেছেন, গত ৫,০০০ বছরে এমন কিছু জিনকে বেছে নেওয়া হয়েছে যা ঘোড়ার উদ্বেগপূর্ণ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের শরীরকে পরিবহনের জন্য আরও উপযুক্ত করে তোলে।
আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক ঘোড়াদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৪,২০০ বছর আগে কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরের তৃণভূমিতে বাস করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঘোড়া ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক কীভাবে গড়ে উঠেছিল?
গবেষকরা 'ZFPM1' নামের একটি জিনের সংস্করণ খুঁজে পেয়েছেন, যা প্রায় ৫,০০০ বছর আগে সাধারণ হয়ে ওঠে। ঘোড়ার বৈশিষ্ট্যের ওপর এর সঠিক ভূমিকা জানা না গেলেও, ইঁদুরের মধ্যে এই জিনটি উদ্বেগপূর্ণ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এর থেকে গবেষকরা মনে করছেন, মানুষ শুরুতেই এমন ঘোড়া বেছে নিয়েছিল যারা মানুষকে কম ভয় পেত বা খাঁচায় বন্দী থাকলেও শান্ত থাকত।
গবেষণা দলের প্রধান লুডোভিক অরল্যান্ডো বলেন, "আমরা মনে করি এটি ছিল প্রথম ধাপ। মানুষ সম্ভবত এমন ঘোড়া বেছে নিয়েছিল যারা বেশি পোষ মানত এবং শান্ত ছিল।" তিনি আরও বলেন, "এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত যে আপনি এমন একটি প্রাণী বেছে নেবেন যা আপনার সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।"
এরপর, বিজ্ঞানীরা আরেকটি জিনগত পরিবর্তন শনাক্ত করেন যা প্রায় ৪,৭০০ বছর আগে থেকে ঘোড়াদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটি 'GSDMC' নামক জিনের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে, এটি ১ শতাংশ ঘোড়া থেকে বেড়ে প্রায় সব ঘোড়ার মধ্যে সাধারণ হয়ে যায়।
এই জিনের কাজ কী তা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা শুধু ঘোড়ার জিনোমই দেখেননি, পরীক্ষাও করেছেন। তারা ইঁদুরের মধ্যে জিনগত পরিবর্তন করে প্রাচীন ঘোড়ার ওই জিন প্রবেশ করান। সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায়, এতে ইঁদুরদের পিঠ চ্যাপ্টা হয়ে গেছে এবং সামনের পা আরও শক্তিশালী হয়েছে। আরেকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, জিনটি তাদের আরও বেশি চটপটে করে তুলেছে।
অবশ্যই, ইঁদুর আর ঘোড়া এক নয়। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো থেকে ধারণা করা যায় যে, একই জিনগত পরিবর্তন ঘোড়ার পিঠকে মানুষের ওজন বহনের জন্য এবং দ্রুত চলাচলের জন্য শরীরকে আরও উপযুক্ত করেছে।
উইলিয়াম টেলর, কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, বলেন, "গবেষণার ফলাফল সত্যিই দারুণ। তারা দেখিয়েছেন যে, মানুষ ও পোষা ঘোড়ার মধ্যে প্রাথমিক সম্পর্ককে মাত্র দুটি জিনিস প্রভাবিত করেছিল—তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাব কমানো এবং পরিবহনের জন্য তাদের শারীরিক গঠন।"
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, উচ্চতা এবং গায়ের রঙের মতো অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও নির্বাচন করা হয়েছে, তবে তা অনেক পরে। প্রায় ২,৭০০ বছর আগে উচ্চতা এবং শরীরের আকারের জন্য দায়ী জিনগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মানুষের পছন্দের পরিবর্তন ঘোড়ার জিনোমেও দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ১,৯০০ বছর পর্যন্ত বাদামী রঙের ঘোড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়, পরে তা কমতে থাকে। রূপালি রঙের ঘোড়াও নির্বাচিত হয়েছে।
টেলর আরও উল্লেখ করেন, জিনগত প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের সাথে মিলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, "ঘোড়ার উচ্চতা এবং বড় আকারের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনগুলো ঠিক সেই সময়ই জনপ্রিয় হতে শুরু করে, যখন আমরা প্রাচীন বিশ্বে অশ্বারোহী বাহিনী এবং ব্যাপকভাবে ঘোড়ায় চড়ার প্রচলন দেখতে পাই।"
এই গবেষণাটি ঘোড়া পোষ মানানোর পেছনের জিনগত পরিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে কেবল প্রথম ধাপ মাত্র। কারণ গবেষকরা ঘোড়ার জিনোমের মাত্র ২৬৬টি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ে কাজ করেছেন। তাছাড়া অনেক বৈশিষ্ট্যই একাধিক জিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
লরেন্ট ফ্রান্তজ, মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশেষজ্ঞ, হাজার হাজার বছর আগে কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরের তৃণভূমির মানুষের প্রজনন দক্ষতায় বিস্মিত। তিনি উল্লেখ করেন, প্রায় এক হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ার বোতাই নামক সংস্কৃতির লোকেরাও ঘোড়া পালন করত, কিন্তু তারা মূলত মাংস ও দুধের জন্য করত, চড়ার জন্য নয়।
এর থেকে বোঝা যায়, আধুনিক ঘোড়া তৈরির জন্য শুধু চড়ার উপযোগী ঘোড়াই যথেষ্ট ছিল না। এমন মানুষেরও প্রয়োজন ছিল যারা পরিবহনের জন্য তাদের বেছে নিতে পারত। এই মানুষগুলো কারা ছিল তা এখনও রহস্য, কিন্তু তাদের প্রজনন কৌশল ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী।
ফ্রান্তজ বলেন, "হাজার হাজার বছর আগে ঘোড়া বাছাইয়ের এই দক্ষতা আমরা আজকের আধুনিক পশু প্রজননের মধ্যেও দেখতে পাই।"