গাছের শব্দে সাড়া দেয় মথ, এড়িয়ে চলে বেশি ‘কোলাহলপূর্ণ’ বৃক্ষ
মানুষের কানে না এলেও গাছ শব্দ তৈরি করে। এই শব্দ হয় আল্ট্রাসাউন্ডে, যা অতিরিক্ত তীব্র হওয়ায় আমরা শুনতে পাই না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিশেষ যন্ত্র দিয়ে বহু বছর ধরে এই শব্দ শুনে আসছেন।
এই প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের একদল গবেষক প্রমাণ পেয়েছেন, পোকামাকড় এই শব্দ শুনতে পারে এবং তা বুঝে সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকে । এই আবিষ্কার আগের এক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, টমেটো ও তামাক গাছ পানির ঘাটতিতে থাকলে তারা বিশেষ শব্দ উৎপন্ন করে। গবেষণা দলের প্রধান লেখক তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও পিএইচডি গবেষক রিয়া সেল্টজার বলেন, "ধারণা করা হচ্ছে, এই শব্দ তৈরি হয় গাছের জলবাহিত কোষ জাইলেমে পানির ভারসাম্য পরিবর্তনের কারণে।"
যখন গাছ পানিশূন্যতায় থাকে, তখন জাইলেম টিস্যুতে বায়ুর বুদবুদ তৈরি হয়, তা বড় হয় এবং ফেটে যায়। এই প্রক্রিয়ায় কম্পন হয়, যার ফলে প্রতি কিছু সেকেন্ড পরপর এক ধরনের ক্লিক-ধরনের শব্দ হয়। এই শব্দ ২০ থেকে ১০০ কিলোহার্জ ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে থাকে। গবেষকরা বলছেন, পোকামাকড় প্রায় ৫ মিটার দূর থেকেও এই শব্দ শুনতে পায়। তবে ২০ কিলোহার্জের বেশি ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ সাধারণত মানুষের শ্রবণ ক্ষমতার বাইরে বলে মানুষ তা শুনতে পায়না।
এই অতিতীব্র শব্দগুলো পোকামাকড় শুনতে পায় কিনা তা জানতে বিজ্ঞানীরা ইজিপশিয়ান কটন লিফওয়ার্ম মথ (Spodoptera littoralis) নামক পতঙ্গের পর্যবেক্ষণ করেন। দেখা গেছে, এই মথ ডিম পারার সময় বেশি শব্দ করে এমন গাছ যেমন টমেটো গাছ এড়িয়ে চলে। তারা এমন গাছ বেছে নেয়, যেগুলো কম শব্দ করে এবং যেগুলোর পাতা নবজাতক লার্ভার জন্য বেশি পুষ্টিকর।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইয়ালি ঝাং বলেন, "এই গবেষণায় দেখা গেল, কীভাবে প্রাণীরা আশপাশের সংকেত শুনে প্রতিক্রিয়া জানায়। এই ক্ষেত্রে, গাছের কোষের থেকে উৎপন্ন শব্দ শুনে পতঙ্গ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।"
তবে সেল্টজার জানান, মথ এই শব্দ শুনে প্রতিক্রিয়া জানালেও, এর মানে এই নয় যে গাছ ও মথের মধ্যে কথা হচ্ছে। তিনি বলেন, "আমরা একটি পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া দেখেছি, যোগাযোগ নয়। গাছ সচেতনভাবে পোকাকে কিছু জানাতে শব্দ করছে না। এটা তাদের পরোক্ষ আচরণ।"
মথ পোকা কিভাবে শব্দ শুনে গাছ বেছে নেয়
গবেষকরা যখন শুকিয়ে যাওয়া একটি টমেটো গাছ আর একটি সতেজ গাছের সামনে নারী মথ পোকাদের নিয়ে এলেন, তারা ডিম পাড়ার জন্য গিয়ে বসল সেই সতেজ পাতাটিতে। এতে একরকম বোঝাই গেল, সুস্থ গাছ তাদের বেশি টানে। তবে বিজ্ঞানীরা জানতে চাচ্ছিলেন এই সিদ্ধান্তে কি গাছের উৎপন্ন শব্দের কোনো প্রভাব আছে কিনা।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তারা তৈরি করলেন দুটি বাক্স নিয়ে একটি ছোট্ট পরীক্ষাগার। একটি বাক্সে বাজানো হচ্ছিল গাছের 'চাপের শব্দ', আর অন্যটি ছিল একদম নিঃশব্দ। দেখা গেল, মথ পোকারা বেশি যাচ্ছিল সেই শব্দ হওয়া বক্সের দিকে, সম্ভবত তাদের মনে হচ্ছিল, শব্দ মানেই হয়তো জীবন্ত গাছ। কিন্তু যখন পোকাগুলোর শ্রবণক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হলো, তখন আর কোনো বাছবিচার দেখা গেল না। গবেষকরা বলছেন, এর মানে মথ পোকারা শব্দ শুনেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল।
আরও একটি পরীক্ষায়, দুইটি সুস্থ টমেটো গাছের পাশে রাখা হলো একটি স্পিকার, যেটি বাজাচ্ছিল গাছের তৈরি আল্ট্রাসনিক চাপের শব্দ। এবার দেখা গেল, বেশিরভাগ পোকাই বেছে নিল অপেক্ষাকৃত নিরব গাছটিকে।
তৃতীয় পরীক্ষায় দেখা হলো, নারী মথ পোকারা পুরুষ পোকার ডাকা শব্দে প্রভাবিত হয় কি না। পুরুষ মথরা একধরনের আল্ট্রাসাউন্ড 'ক্লিক' শব্দ করে প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেল এ ব্যাপারে পোকাদের মধ্যে তেমন কোনো পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হয়নি।
এই তিনটি পরীক্ষার ফলাফল একসাথে ইঙ্গিত দেয় মথ পোকারা গাছের উচ্চতর শব্দ শুনতে পায়, বোঝে, এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় ডিম কোথায় পাড়বে। সেল্টজার বলছেন, "এই গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, পোকারা গাছের শব্দের সঙ্গে তাদের বংশবিস্তারের সিদ্ধান্তকে জুড়ে নিচ্ছে।"
বিস্ময় আর সম্ভাবনার দুয়ার
আধুনিক পোকাদের শ্রবণক্ষমতা প্রায় ৫ কোটি বছর আগের 'ইওসিন যুগ' থেকেই আছে। কিন্তু এমন শব্দ যা গাছ বানাচ্ছে তা পোকারা শুনতে পেরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এই আবিষ্কারে রীতিমতো চমকে গেছেন গবেষকরা। সেল্টজার জানালেন, এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নারী পোকাগুলোর এর আগে কখনো ডিম পাড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না, তারপরও তারা শব্দ শনাক্ত করে সঠিক গাছ বেছে নিতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক ঝাং বলছেন, "গাছের গন্ধ যে পোকা আকর্ষণ বা প্রতিরোধে কাজ করে, তা আমরা আগেই জানতাম। কিন্তু শব্দ? এটা সত্যিই নতুন এক তথ্য।"
গাছের শব্দবিজ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ বাড়ছে। সেল্টজার বলছেন, গাছের এমন শব্দ তৈরি হয় অনেক ব্যাপকভাবে এবং ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবস্থাপনা বা গাছের চাপ বুঝতে এই শব্দ বিশ্লেষণ কাজে লাগতে পারে।
"এটা শুরু মাত্র," বলছেন সেল্টজার, "এমন অগণিত প্রাণী আছে, যারা এই উচ্চতর শব্দ শুনতে পায়, হয়তো আরও অনেক রকম গাছের শব্দ আমরা এখনো জানিই না।"
"আমরা এখনো শুধু বরফের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি", বলেন তিনি।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা
