প্রাচীন কঙ্কালের গর্ভাবস্থা পরীক্ষার চেষ্টায় আরও এক ধাপ এগোল বিজ্ঞানীরা
বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী সাফল্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তারা এমন একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন, যা দিয়ে প্রাচীন মানব কঙ্কাল পরীক্ষা করে গর্ভাবস্থার সাথে যুক্ত হরমোন শনাক্ত করা সম্ভব। এই আবিষ্কার প্রত্নতাত্ত্বিকদের বলে দিতে পারবে, মৃত্যুর সময় কোনো নারী গর্ভবতী ছিলেন কিনা বা সম্প্রতি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন কিনা!
'জার্নাল অফ আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স'-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, গবেষকরা প্রায় ১,০০০ বছরের পুরনো কঙ্কালের হাড় এবং দাঁতের মতো কঠিন অংশে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন হরমোনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।
এই গবেষণার প্রধান লেখক, শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক এমী বারলো বলেন, 'আমরা কঙ্কাল এবং দাঁতের মধ্যে একটি 'হরমোন আর্কাইভ' আবিষ্কার করেছি।'
বারলো সিএনএনকে বলেন, 'এটি একটি প্রথম ঘটনা। এর আগে কেউ দাঁত বা ডেন্টাল ক্যালকুলাসে (দাঁতের পাথর) এই নির্দিষ্ট হরমোনগুলো শনাক্ত করতে পারেনি। মানুষের হাড়ের টিস্যুতেও প্রথমবারের মতো সফলভাবে প্রোজেস্টেরন পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে।'
প্রাচীন মানব কঙ্কালে গর্ভাবস্থা শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। বিজ্ঞানীরা আগে বিশ্বাস করতেন যে, হাড়ের গঠন এতটাই অজৈব যে এই ধরনের প্রোটিনগুলো টিকে থাকা বা শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু বারলো এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথম থেকে উনবিংশ শতাব্দীর সাতজন নারী এবং তিনজন পুরুষের কঙ্কালের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য 'এনজাইম-লিঙ্কড ইমিউনোসর্বেন্ট অ্যাসে (এলিসা)' নামক একটি কৌশল ব্যবহার করেন। 'এলিসা' হলো একটি প্রচলিত পদ্ধতি, যা প্রোজেস্টেরনের মতো অণু শনাক্ত ও পরিমাপ করতে পারে। প্রোজেস্টেরন গর্ভাবস্থার একটি মূল সূচক, যার মাত্রা গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকে নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় এবং পুরো সময় জুড়ে বজায় থাকে।
গবেষণা অনুসারে, এই সময়ে ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রাও বাড়ে, তবে প্রোজেস্টেরনের মতো অতটা নয়। তাই তিনটি হরমোনের মধ্যে সম্পর্ক বিবেচনা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, হাড় এবং দাঁতের বিভিন্ন অংশ—যেমন ডেন্টিন, এনামেল, ক্যালকুলাস এবং মূল থেকে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরন পরিমাপ করা সম্ভব। গবেষণাপত্রে লেখকরা বলেছেন, 'দাঁতের কাঠামো এবং ক্যালকুলাসে উচ্চ প্রোজেস্টেরনের মাত্রা, হাড়ে ইস্ট্রোজেনের উপস্থিতি এবং কঠিন টিস্যুতে টেস্টোস্টেরনের অভাব—এই লক্ষণগুলো মৃত্যুর সময় গর্ভবতী থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।'
বারলো বলেন, এই প্রমাণটি আগামী দিনে আরও বহু বছরের গবেষণার মাধ্যমে গবেষকদের বলে দিতে পারবে—কোনো নারী কত বছর বয়সে প্রথম গর্ভবতী হয়েছিলেন, তিনি গর্ভপাতের শিকার হয়েছিলেন কিনা, এবং একাধিক সন্তান থাকলে তাদের জন্মের মধ্যে কত সময়ের ব্যবধান ছিল।
তিনি আরও বলেন, 'এটি সেইসব ঐতিহাসিক সময়ের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর হবে, যখন কোনো লিখিত নথি ছিল না।'
তবে এই কৌশলটি প্রাচীন দেহাবশেষের ওপর ব্যবহারের জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন। এর জন্য একটি বৃহত্তর গবেষণা চালাতে হবে, যেখানে জীবিত ব্যক্তিদের বিস্তারিত মেডিকেল রেকর্ডের সাথে তাদের কঙ্কালের হরমোনের মাত্রার একটি বেসলাইন বা ভিত্তি স্থাপন করা হবে।
বারলো বলেন, 'দ্বিতীয়ত, আমাদের এর পেছনের মূল বিজ্ঞানটি বুঝতে হবে। আমাদের জানতে হবে কীভাবে এই হরমোনগুলো হাড় বা দাঁতের বিভিন্ন টিস্যুতে প্রবেশ করে এবং সংরক্ষিত থাকে। এবং বিভিন্ন সমাধিস্থ পরিবেশে সময়ের সাথে সাথে কীভাবে এই হরমোনগুলো সংরক্ষিত থাকে বা ভেঙে যায়, তাও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।'
'যুগান্তকারী' আবিষ্কার
কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ফরেনসিক মেডিকেল সায়েন্সের অধ্যাপক নিকোলাস লেমোস, যিনি এই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না, সিএনএনকে বলেন, 'এটি একটি অগ্রণী গবেষণা... যা বিশ্বে প্রথমবার এমন সাফল্য অর্জন করেছে।'
লেমোস উল্লেখ করেন যে, নমুনার আকার 'খুবই ছোট' ছিল, যেখানে ১০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন মৃত্যুর সময় গর্ভবতী ছিলেন। তাই 'এলিসা' পদ্ধতিটির 'আরও পরীক্ষা এবং বৈধতা' প্রয়োজন।
তিনি বলেন, 'সংক্ষেপে, যদিও এই ফলাফলগুলো যুগান্তকারী, তবে এগুলোকে এখনও একটি ধারণার প্রমাণ হিসেবে দেখা উচিত, রুটিন ডায়াগনস্টিক টুল হিসেবে নয়। কাজটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, এটি সুদূর অতীতে জীবন ও মৃত্যুর হরমোনাল মাত্রা বোঝার দিকে একটি অসাধারণ পদক্ষেপ।'
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের এন্ডোক্রিনোলজির অধ্যাপক কমনিনোস, যিনি এই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না, এই গবেষণাকে 'চমকপ্রদ' বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'অতীতের প্রজনন চিত্র বোঝার মাধ্যমে, আমরা জানতে পারব সময়ের সাথে সাথে কীভাবে পরিবর্তন এসেছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেরও কিছু আভাস পেতে পারি। এছাড়াও, হাড়ে এই মূল হরমোনগুলো শনাক্ত করার ক্ষমতা হাড়ের ক্ষেত্রে সমসাময়িক আরও নতুন গবেষণার জন্ম দিতে পারে।'
