মস্তিষ্ক যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তার মানচিত্র প্রকাশ করলেন বিজ্ঞানীরা
ইতিহাসে প্রথমবার, ২২টি দেশের স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা এমন একটি মানচিত্র তৈরি করেছেন, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পুরো মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে চোখের সামনে তুলে ধরে।
১৩৯টি ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এতে মস্তিষ্কের ২৭৯টি অঞ্চলের ৬ লক্ষেরও বেশি নিউরনের কার্যকলাপের তথ্য রয়েছে, যা একটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের প্রায় ৯৫ শতাংশ। এই প্রথমবার বিজ্ঞানীরা দেখতে পাচ্ছেন, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তে মস্তিষ্কের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঠিক কী ঘটে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. পল ডব্লিউ গ্লিমচার এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, "তারা এমন এক বিশাল তথ্যভান্ডার তৈরি করেছেন, যা এই স্তরে কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারেনি।" গ্লিমচার নিজে এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তিনি সিএনএনকে বলেন, "স্নায়ুবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।"
এই মানচিত্র তৈরির জন্য গবেষকরা প্রথমে সব গবেষণাগারের জন্য একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি তৈরি করেন। এরপর ইঁদুরকে পর্দায় দেখানো ছবির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় এবং একই সময়ে তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়। সাত বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টা শেষে এই গবেষণার ফলাফল গত ৩ সেপ্টেম্বর 'নেচার' জার্নালে দুটি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
একটি নিউরন থেকে লক্ষ লক্ষ নিউরনের জগৎ
কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা একটি বা দুটি নিউরনের কার্যকলাপ রেকর্ড করে মস্তিষ্কের রহস্য বোঝার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কাজ হতো খুব ধীর গতিতে।
তবে গত দশকে 'নিউরোপিক্সেলস' নামক ডিজিটাল প্রোব আবিষ্কারের ফলে স্নায়ুবিজ্ঞানে বিপ্লব আসে। এই যন্ত্রটি একসঙ্গে হাজার হাজার নিউরনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। নতুন এই মানচিত্র তৈরিতে এই প্রযুক্তিই ছিল মূল হাতিয়ার।
গবেষণার জন্য ইঁদুরদের মাথায় ইলেক্ট্রোডের হেলমেট পরানো হয় এবং তাদের একটি ছোট স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে পর্দার একটি সাদাকালো বৃত্তকে মাঝখানে আনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সঠিকভাবে কাজটি করতে পারলে তাদের পুরস্কার হিসেবে মিষ্টি পানি দেওয়া হতো। ইঁদুর যখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে হুইল ঘোরাত, তখনই নিউরোপিক্সেল প্রোব তাদের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সংকেত রেকর্ড করত।
মানচিত্রে দেখা যায়, প্রথমে মস্তিষ্কের পেছনের অংশে কার্যকলাপ শুরু হয়, যা দেখার অনুভূতি প্রক্রিয়াকরণ করে। এরপর সিদ্ধান্তটি যখন কাজে পরিণত হয়, তখন পুরো মস্তিষ্কে সংকেতের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে, পুরস্কার পাওয়ার পর মস্তিষ্কের বিশাল অংশজুড়ে কার্যকলাপ দেখা যায়।
এই গবেষণার অন্যতম লেখক আলেকজান্দ্রে পৌগেট বলেন, "এটি প্রমাণ করে যে সিদ্ধান্ত শুধু মস্তিষ্কের কয়েকটি ছোট অংশ নেয় না, বরং এটি একটি বিশাল নেটওয়ার্কের সমন্বিত কাজ।"
পূর্ব অভিজ্ঞতাই সিদ্ধান্তের চাবিকাঠি
গবেষকরা ইঁদুরদের জন্য একটি অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ রেখেছিলেন। কখনও কখনও পর্দার বৃত্তটি এতটাই অস্পষ্ট করে দেওয়া হতো যে, দেখার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ইঁদুরকে তার আগের প্রচেষ্টাগুলোর কথা মনে করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো।
পৌগেট বলেন, "একেই বলা হয় পূর্ব অভিজ্ঞতা। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এভাবেই নিই।"
বিজ্ঞানীরা আগে ধারণা করতেন যে, মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শুরুতেই পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়। এই মানচিত্র প্রমাণ করেছে যে তাদের সেই ধারণাটি সঠিক ছিল।
এই গবেষণা স্নায়ুবিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যেমনভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একত্রিত হয়ে মহাবিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছেন, ঠিক তেমনি স্নায়ুবিজ্ঞানীরাও মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনে একসঙ্গে কাজ করা শুরু করেছেন।
আন্তর্জাতিক ব্রেইন ল্যাবরেটরির (আইবিএল) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পৌগেট বলেন, "আমরা আশা করছি, আমাদের এই কাজ অন্য গবেষকদেরও এমন বড় পরিসরে একসঙ্গে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে।"
