মস্তিষ্কের ছোট এই ‘নীল বিন্দু’ যেভাবে আপনার ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে

অনিদ্রায় ভোগা মানুষমাত্রই জানেন, এটি কতটা হতাশা ও অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। ঘুমানোর জন্য বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া অত্যন্ত বিরক্তিকর। এমন পরিস্থিতিতে মানসিক কার্যকলাপ দ্রুত থামানোর উপায় খুঁজতে থাকেন অনেকে। খবর বিবিসি'র।
বর্তমানে বেশিরভাগ নিউরোসায়েন্টিস্ট মনে করেন, আমাদের জাগ্রত অবস্থা একটানা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ওপর নির্ভরশীল, যা মস্তিষ্কের জটিল কিছু নেটওয়ার্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর কেন্দ্রস্থলে রয়েছে 'লোকাস কোরুলিয়াস' নামের ছোট্ট একটি নিউরনগুচ্ছ। লাতিন ভাষায় এর অর্থ 'নীল বিন্দু'। এই নামকরণ শুধু প্রতীকী নয়, বাস্তবও। এখানে থাকা নিউরনগুলো 'নরেপিনেফ্রিন' নামক এক বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটার উৎপন্ন করায় নীল বর্ণ ধারণ করে। এই রাসায়নিক পদার্থই আমাদের শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনা তথা জাগ্রত অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে।
অনেক দিন ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ঘুমের সময় লোকাস কোরুলিয়াস নিষ্ক্রিয় থাকে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এটি কখনোই পুরোপুরি থেমে যায় না। বরং ঘুমের গভীরতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ প্রক্রিয়া আরও ভালোভাবে বোঝা গেলে উদ্বেগজনিত অনিদ্রার মতো সমস্যার নতুন সমাধান বের করা সম্ভব হতে পারে।
লোকাস কোরুলিয়াস মস্তিষ্কের ব্রেইনস্টেমে, ঘাড়ের পেছনের অংশের ঠিক ওপরে অবস্থিত। এতে প্রায় ৫০,০০০ নিউরন রয়েছে। ১৮ শতকের শেষভাগে ফরাসি চিকিৎসক ফেলিক্স ভিক দাজির এটি প্রথম শনাক্ত করেন। দীর্ঘদিন বিজ্ঞানীদের নজরের বাইরে থাকলেও ২০ শতকে মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণে এর ভূমিকা উদ্ঘাটিত হওয়ার পর এটি নতুন করে আলোচনায় আসে।
নরেপিনেফ্রিন বা নরেড্রেনালিন নিউরনের সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। লোকাস কোরুলিয়াস সক্রিয় হলে এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাসায়নিক প্রেরণ করে, যার ফলে সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে।
তবে এ প্রক্রিয়ার কিছু জটিলতাও রয়েছে। মস্তিষ্কের সব অঞ্চলের নিউরন একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছু নিউরন কম মাত্রার নরেপিনেফ্রিনেই সক্রিয় হয়, আবার কিছু নিউরন উচ্চ মাত্রা ছাড়া প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ফলে লোকাস কোরুলিয়াস যত বেশি সক্রিয় হয়, তত বেশি এটি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশকে প্রভাবিত করে। এর ফলে মনোযোগ, মনঃসংযোগ ও সৃজনশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে।
নিউরোসায়েন্টিস্ট মিথু স্টোরোনি তার বই হাইপার এফিসিয়েন্ট: অপটিমাইজ ইওর ব্রেইন টু ট্রান্সফর্ম দ্য ওয়ে ইউ ওয়ার্ক-এ লোকাস কোরুলিয়াসকে মস্তিষ্কের 'গিয়ারবক্স' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এটি কম সক্রিয় হলে নরেপিনেফ্রিনের মাত্রা কমে যায়, ফলে মনোযোগ ব্যাহত হয়। মাঝারি মাত্রার সক্রিয়তায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত সংকেত তৈরি হয়। এ অবস্থায় যুক্তিবাদী চিন্তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সবচেয়ে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, ফলে একাগ্রতা বাড়ে ও জটিল মানসিক কাজ সহজ হয়।
অন্যদিকে লোকাস কোরুলিয়াস অতিরিক্ত সক্রিয় হলে নরেপিনেফ্রিনের মাত্রাও বেড়ে যায়, যা 'ফাইট-অর-ফ্লাইট' প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করে। এতে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, ফলে আমরা চারপাশের পরিবেশের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে উঠি। এ সময় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাগতে পারে।
লোকাস কোরুলিয়াস সম্পর্কে আরও সচেতনতা উদ্বেগ, মনোযোগের সমস্যা ও ঘুমজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে নতুন পথ উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম নানা উপাদানের কারণে সময়ের সঙ্গে ওঠানামা করে। যেমন, জৈবিক ঘড়ির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে 'নীল বিন্দু' নামে পরিচিত এই অংশটির সক্রিয়তাও ওঠানামা করে। ঘুম ভাঙার পর এটি তুলনামূলক কম সক্রিয় থাকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয়তা বাড়ে এবং সন্ধ্যার দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
'নীল বিন্দু' উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এটি স্বাভাবিকভাবেই রাতে ঘুমের সময় সবচেয়ে কম সক্রিয় থাকে। তবে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় না হয়ে মাঝে মাঝে সক্রিয় হয়। সুইজারল্যান্ডের লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অনিতা লুতি'র মতে, এই অনিয়মিত সক্রিয়তার ধরন আমাদের ঘুমের মান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
রাতের ঘুম বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়। এর একটি হলো 'র্যাপিড আই মুভমেন্ট' (আরইএম) ঘুম, যেখানে চোখের মণি দ্রুত নড়াচড়া করে। এই পর্যায়েই আমরা স্বপ্ন দেখি এবং স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের জন্য এটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

তবে বেশির ভাগ সময় আমরা 'নন-র্যাপিড আই মুভমেন্ট' (এনআরইএম) ঘুমে থাকি। এই অবস্থায় মস্তিষ্ক একটি গভীর পরিচ্ছন্নতার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে কোষীয় বর্জ্য অপসারিত হয়। এর ফলে স্নায়ুজনিত সমস্যা দেখা দেয় না।
ইঁদুরের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে লুতি দেখেছেন, এনআরইএম ঘুমের সময় প্রতি ৫০ সেকেন্ড পরপর 'নীল বিন্দু' সাময়িকভাবে সক্রিয় হয়। এই সক্রিয়তা মস্তিষ্কের থ্যালামাসকে উদ্দীপিত করে, যার ফলে ঘুমন্ত প্রাণী বাইরের শব্দ বা অন্যান্য উদ্দীপনার প্রতি কিছুটা সংবেদনশীল থাকলেও পুরোপুরি জেগে ওঠে না। লুতির মতে, এটি মস্তিষ্কে 'অতিরিক্ত সতর্কতা' তৈরি করে।
গবেষকদের ধারণা, ঘুমের সময়ও পরিবেশ সম্পর্কে কিছুটা সতর্ক থাকার এই প্রক্রিয়া বন্য প্রাণীদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুতি বলেন, 'ঘুম অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে নির্দিষ্ট মাত্রার সজাগতা বজায় রাখা দরকার। পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ।'
আরইএম ঘুমের শুরুতে 'নীল বিন্দু'র কার্যকলাপ খুব কম থাকে, যা ইঙ্গিত দেয় এটি আমাদের স্বপ্নে প্রবেশের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। লুতির মতে, এই পরিবর্তনটি অত্যন্ত সুসংগঠিত হতে হয়, কারণ আরইএম ঘুমের সময় আমাদের শরীর সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। এটি আমাদের স্বপ্নের কাজগুলো বাস্তবে করে ফেলার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে। এই পর্যায়ে আমরা পুরোপুরি পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।
যদিও এই গবেষণা মূলত ইঁদুরের ওপর চালানো হয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে মানুষের ক্ষেত্রেও এটি একই প্রভাব ফেলে কি না। তবে, যদি এমনটাই ঘটে, তাহলে 'নীল বিন্দু'র অনিয়ন্ত্রিত সক্রিয়তা উদ্বেগজনিত সমস্যা ও ঘুমের ব্যাধির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মৃদু মানসিক চাপ—যেমন খাঁচায় আঘাত করা—ইঁদুরের 'নীল বিন্দু' আরও সক্রিয় করে তোলে, ফলে তাদের ঘুম ভেঙে যায়।
এই স্নায়বিক পথের ক্রমবর্ধমান বোঝাপড়া গবেষকদের নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি এমন একটি পরীক্ষা করেছেন, যেখানে কপালের একটি স্নায়ুর ওপর ক্ষীণ বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিয়ে 'নীল বিন্দু'র কার্যকলাপ সাময়িকভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এটি অনিদ্রার চিকিৎসায় কার্যকর কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ঘুমের আগে অতিরিক্ত উদ্দীপনা এড়িয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ। স্টোরোনি তার বইতে লিখেছেন, 'ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে গেলে মস্তিষ্ক তার কার্যক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে এটি উচ্চ স্তরে গিয়ে আটকে যায়।' তাই 'ভালো ঘুমের অভ্যাস' তৈরি করতে চাইলে ঘুমের আগে টিভি, ফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
আমরা আমাদের শরীর ও 'নীল বিন্দু'র পারস্পরিক সংযোগও কাজে লাগাতে পারি। এটি স্বায়ত্তশাসিত স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশ, যা অসচেতনভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপের মতো শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই স্নায়ুতন্ত্র দুটি অংশে বিভক্ত—প্রথমটি সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র, যা দেহের চাপ প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করে; দ্বিতীয়টি প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র, যা বিশ্রাম ও প্রশান্তির জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে। মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে আমরা এই দুটি অংশকে আলাদাভাবে সক্রিয় করতে পারি।
মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার শারীরিক পরিশ্রম—যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, নৌকা বা সাইকেল চালানো—সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে। এর ফলে 'নীল বিন্দু' আরও সক্রিয় হয় এবং মানসিক উত্তেজনা বাড়ে। সকালে ঝিমধরা অনুভব করলে এটি কাজে লাগতে পারে, তবে দীর্ঘ কর্মদিবসের পর মনকে শান্ত করতে চাইলে এটি উপকারী নয়। অনেকেই মনে করেন, রাতের ব্যায়াম ঘুম আনতে সাহায্য করবে, তবে ঘুমের সমস্যা থাকলে দেরিতে জিমে যাওয়া ভালো সিদ্ধান্ত নয়।
অন্যদিকে, হালকা ব্যায়াম প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে, শরীরকে আরামদায়ক অবস্থায় নিয়ে যায় এবং মানসিক প্রশান্তি আনে। যোগব্যায়ামের 'প্রাণায়াম' কৌশল এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।
আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সরাসরি 'সুইচ' নেই। তবে দৈনন্দিন রুটিন সচেতনভাবে গুছিয়ে নেওয়া এবং মস্তিষ্ক-শরীরের পারস্পরিক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর মাধ্যমে গভীর ও প্রশান্তিময় ঘুম নিশ্চিত করা সম্ভব।