কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রি নিয়েও প্রথম চাকরির জন্য হিমশিম খাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের স্নাতকপাশরা

গত বছর যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ও সাইবার সিকিউরিটিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন এডি হার্ট।
প্রযুক্তির বিশাল কর্মজগতে প্রবেশ করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে, তা আগে থেকেই জানতেন এডি। কিন্তু মনে মনে ভাবতেন, পথটা হয়তো এতটা কঠিনও হবে না।
তবে বাস্তবতা হলো, চাকরির বাজারে এসে তিনি একের পর এক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কোনও 'জুনিয়র' পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও, সেগুলোতে প্রায়ই দুই বা তার চেয়ে বেশি বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা চাওয়া হচ্ছে।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'এই ধরনের চাহিদা তো অবাস্তব। এটি ভালো ও যোগ্য প্রার্থীদের আবেদন করা থেকেই নিরুৎসাহিত করছে।'
এতোটুকু এডি নিশ্চিত, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কোডারদের সাধারণ ও প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টুল ব্যবহার করছে।
অথচ, ঐতিহ্যগতভাবে এই কাজগুলোই নতুনদের অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেদের দক্ষ প্রমাণ করার প্রথম ধাপ ছিল। এআই-এর কারণে সেই সুযোগ এখন কমে গেছে, যা এডি হার্টের মতো হাজারো তরুণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে।
এডি বলেন, বিভিন্ন সংস্থা তাদের কার্যক্রমের কিছু অংশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে নিঃসন্দেহে লাভবান হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তিনি মনে করেন না যে ডেভেলপারদের সম্পূর্ণরূপে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা একটি টেকসই সমাধান হতে পারে।
চ্যাটজিপিটি এবং এই ধরনের অন্যান্য কোডিং টুলগুলোর কারণে প্রযুক্তি খাতে চাকরির সুযোগ, বিশেষ করে তরুণ সফটওয়্যার ডেভেলপার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য, আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে বলে অভিযোগও রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন রিসার্চের (এনএফইআর) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে প্রযুক্তি খাতে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নতুনদের জন্য বা এন্ট্রি-লেভেলের পদগুলো। প্রতিবেদনটিতে এই ধসের অন্যতম কারণ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রত্যাশিত প্রভাব এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সাথে, সফটওয়্যার ডেভেলপাররা একদিকে যেমন নিজেদের কাজের জন্য ব্যাপকভাবে এআই কোডিং টুল ব্যবহার করছেন, তেমনই এর ফলাফলের উপর পুরোপুরি আস্থাও রাখতে পারছেন না।

সফটওয়্যার বিষয়ক তথ্য শেয়ার করার প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাক ওভারফ্লো-র একটি গবেষণা বলছে, প্রায় অর্ধেক ডেভেলপার প্রতিদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টুল ব্যবহার করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ এই টুলগুলোর দেওয়া ফলাফলের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখেন।
বর্তমান পরিস্থিতিকে স্নাতকদের জন্য 'একটি কঠিন সময়' বলে উল্লেখ করে স্ট্যাক ওভারফ্লো-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত চন্দ্রশেখর বলেন, তাদের গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, অনেক ডেভেলপার তাদের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেও তারা চাকরি ছাড়ছেন না, বরং বর্তমান কর্মস্থলেই থাকাকে বেছে নিচ্ছেন।
এই সবকিছুর ফলে তরুণ প্রযুক্তিবিদদের জন্য প্রথম একটি নির্ভরযোগ্য চাকরি খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। চাকরি খুঁজে পাওয়ার মানসিক চাপকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে আবেদন প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার।
এডি হার্টের অভিজ্ঞতাটা বেশ তিক্ত। তিনি এমন একটি স্বয়ংক্রিয় আবেদন প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যেখানে আটটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপ ছিল। এর প্রথম ধাপেই নিজের সম্পর্কে পরীক্ষার আদলে তৈরি ২০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে তাকে। এই ধরনের অনলাইন পরীক্ষা শেষ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয় বলে তিনি জানান।
এমনকি তার বন্ধুদের অনেককে সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ভিডিওতে রেকর্ড করে আপলোড করতে বলা হয়েছে।
হতাশ কণ্ঠে হার্ট বলেন, 'এরপর একটি এআই সেই ভিডিও আবেদন পর্যালোচনা করে, এমনকি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটিও নেয় একটি কম্পিউটার। আপনার মনে হবে, একজন মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার যে ন্যূনতম সম্মান, সেটাও আপনি পাচ্ছেন না।'
যদিও এডি হার্ট স্বীকার করেন যে, বাজারে জ্যেষ্ঠ বা সিনিয়র পদগুলোতে এখনও চাকরির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তার প্রশ্ন, তার মতো তরুণ ডেভেলপাররা যদি চাকরিতে প্রবেশই করতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে এই সিনিয়র পদগুলো পূরণ করবে কারা?
অর্থনৈতিক মন্দা বা প্রযুক্তি খাতের যেকোনো বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রথম আঘাতটা সবসময় নবীন বা জুনিয়র সফটওয়্যার ডেভেলপারদের ওপরই আসে বলে মনে করেন ক্যালিফোর্নিয়ার ডেটাবেস ফার্ম ইনফ্লাক্সডেটা-র সিটিও এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল ডিক্স।
তবে তিনি একটি গুরুতর সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। তার মতে, 'যদি কোনো প্রতিষ্ঠানই তরুণ ডেভেলপারদের নিয়োগ না দেয়, তাহলে একটা সময়ে গিয়ে আপনি আর সিনিয়র ডেভেলপারও খুঁজে পাবেন না। কারণ, আপনি আপনার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির পথটাই পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছেন।'
স্ট্যাক ওভারফ্লো-র সিইও প্রশান্ত চন্দ্রশেখর মনে করেন, যেসব বড় সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তারা এখন সেই বিনিয়োগের সুফল দেখাতে চাপের মধ্যে রয়েছে। আর সেই চাপ থেকেই হয়তো তারা নতুন কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছে।
যদিও স্ট্যাক ওভারফ্লো-র গবেষণা অনুসারে, এখনও ৬৪ শতাংশ ডেভেলপার এআই-কে তাদের চাকরির জন্য হুমকি বলে মনে করেন, তবে এই সংখ্যাটি গত বছরের তুলনায় চার শতাংশ কম।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে চন্দ্রশেখর উল্লেখ করেন, 'ডেভেলপাররা এখন এআই-এর সীমাবদ্ধতাগুলো দেখতে শুরু করেছেন। তারা বুঝতে পারছেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা যাচাইয়ের জন্য মানুষের হস্তক্ষেপ জরুরি।'
প্রশান্ত চন্দ্রশেখর অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন, এর আগেও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন পরিবর্তনের সময় সিনিয়র এবং জুনিয়র সব ধরনের চাকরি হারিয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, এই ধরনের পরিবর্তন আরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করে, কারণ মানুষ নতুন নতুন সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করে আনে।