ভারতের কলসেন্টার কর্মীদের জায়গা দখল করছে যেসব এআই চ্যাটবট

ভারতের এক শহরের একটি স্টার্টআপ অফিসে ডেভেলপাররা এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবটকে নিখুঁত করে তুলছেন, যা মানুষের মতোই কথা বলে এবং মেসেজ পাঠায়।
লাইমচ্যাট নামের এই সংস্থার লক্ষ্য হলো কাস্টমার সার্ভিস বা গ্রাহক পরিষেবার চাকরিকেই প্রায় বিলুপ্ত করে দেওয়া। সংস্থাটি বলছে, তাদের জেনারেটিভ এআই এজেন্ট ক্লায়েন্টদের প্রতি মাসে ১০,০০০ গ্রাহকের প্রশ্ন সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীর সংখ্যা ৮০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
এর ২৮ বছর বয়সী সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিখিল গুপ্তা রয়টার্সকে বলেন, "একবার লাইমচ্যাটের এজেন্ট নিয়োগ করলে, আপনাকে আর কখনও কর্মী নিয়োগ করতে হবে না।"
সস্তা শ্রম আর ইংরেজিতে দক্ষতা ভারতকে 'বিশ্বের ব্যাক অফিস' বানাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন, এআই-চালিত সিস্টেমগুলো টেকনিক্যাল সাপোর্ট, গ্রাহক পরিষেবা এবং ডেটা ম্যানেজমেন্টের মতো কাজগুলো কেড়ে নিচ্ছে। এর ফলে টিকে থাকার জন্য এক প্রকার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে এসব খাতের কর্মীদের।
এই পরিবর্তন এআই স্টার্টআপগুলোর জন্য ব্যবসার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে, যারা সংস্থাগুলোকে কর্মী খরচ কমাতে এবং কার্যক্রম বাড়াতে সাহায্য করছে। তবে অনেক গ্রাহক এখনও মানুষের সাথেই কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন।
প্রযুক্তি যখন রুটিন কাজগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে, তখন ভারত গতি কমানোর পরিবর্তে তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশটির এই বাজি ধরার ফলাফল তার সীমান্তের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।এই পরীক্ষা দেখিয়ে দেবে যে এআই-চালিত এই পরিবর্তন একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে, নাকি এটি একটি সতর্কতামূলক গল্পে পরিণত হয়।
চাকরি হারানোর ভয় এবং বাস্তবতা
ভারতে কল সেন্টার, পেরোল এবং ডেটা হ্যান্ডলিং-এর মতো ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১৬.৫ লক্ষ কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন। কিন্তু অটোমেশন এবং ডিজিটাইজেশনের কারণে এই খাতে নিয়োগ ব্যাপকহারে কমে গেছে।
৩২ বছর বয়সী মেঘা এস. বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক একটি সফটওয়্যার সংস্থায় বছরে ১০,০০০ ডলার আয় করতেন। তিনি জানান, গত মাসেই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, কারণ সংস্থাটি সেলস কলের মান পর্যালোচনার জন্য এআই টুল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মেঘার কথায়, "আমাকে বলা হয়েছিল, আমিই প্রথম যাকে এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমি এখনও আমার বাবা-মাকে এ কথা বলিনি।"
তবে, একজন ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সরকার বিশ্বাস করে যে এআই শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক কর্মসংস্থানে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।
'অটোমেশন গোল্ড রাশ'
বিনিয়োগ ব্যাংক জেফরিস ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, আগামী পাঁচ বছরে ভারতের কল সেন্টারগুলো এআই ব্যবহারের কারণে ৫০% এবং অন্যান্য ব্যাক-অফিস ফাংশনগুলো প্রায় ৩৫% রাজস্ব হারাতে পারে। এর অর্থ হলো, ভারতের জন্য স্বল্পমেয়াদে ব্যাপক চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং বাজারের ৫২% নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে এই চাহিদার একজন সুবিধাভোগী হলো লাইমচ্যাট। এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গুপ্তা বলেন, তার ডেভেলপার এবং ইঞ্জিনিয়াররা ভারতজুড়ে ৫,০০০ চাকরি স্বয়ংক্রিয় করতে সাহায্য করেছেন। সংস্থাটির বটগুলো তার ক্লায়েন্টদের জন্য ৭০% গ্রাহকের অভিযোগ সামলায় এবং এক বছরের মধ্যে এটি ৯০-৯৫% করার পরিকল্পনা রয়েছে।
গুপ্তা বলেন, "আপনি যদি আমাদের প্রতি মাসে ১,০০,০০০ রুপি দেন, তবে আপনি কমপক্ষে ১৫ জন এজেন্টের কাজ স্বয়ংক্রিয় করছেন।" এই দামে—প্রায় ১,১৩০ ডলার—এই পরিষেবাটির খরচ প্রায় তিনজন গ্রাহক পরিষেবা কর্মীর বেতনের সমান।
লাইমচ্যাটের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে রয়েছে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স, যারা ২০১৯ সালে ভারতীয় স্টার্টআপ হ্যাপটিককে কিনে নেয়। হ্যাপটিকের বিজ্ঞাপনে প্রশ্ন করা হয়: "ভাবুন তো, আপনার যদি এমন একজন কর্মী থাকত, যে কখনও ঘুমায় না এবং যার বেতন মাত্র ১০,০০০ টাকা?"
কফি উইথ নেহা: যখন বট কথা বলে
এআই-এর প্রতিশ্রুতি এবং বিপদ দুটোই বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক বিজ্ঞাপন সংস্থা 'দ্য মিডিয়া অ্যান্ট'-এ স্পষ্ট। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সমীর চৌধুরী বলেন, গত এক বছরে তারা তাদের কর্মীর সংখ্যা ৪০% কমিয়ে প্রায় ১০০ জনে নামিয়ে এনেছে।
সংস্থাটি ১৫ জন সেলসপার্সনকে বাদ দিয়ে তাদের জায়গায় এআই বট বসিয়েছে, যা সম্ভাব্য গ্রাহকদের খুঁজে বের করে এবং ইমেল পাঠায়। ছয় সদস্যের একটি কল সেন্টারকে 'নেহা' নামের একটি ভয়েস এজেন্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, যা প্রায় নিখুঁত ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলে।
রয়টার্সের একজন রিপোর্টার যখন নেহাকে ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তখন সে বাজেট এবং টার্গেট মার্কেট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায় এবং হাসিমুখে কথোপকথন শেষ করে: "আমি আপনাকে বিস্তারিত ইমেল করে দেব... আপনার দিনটি ভালো কাটুক।" চৌধুরী মজা করে বলেন, "ওকে কফি খেতে ডাকলে ও হেসে উড়িয়ে দেবে।"
জাভা থেকে এআই: বদলে যাচ্ছে প্রশিক্ষণের ধরণ
১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে, ভারতের প্রযুক্তি বিপ্লব গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনকে উৎসাহিত করেছিল। হায়দ্রাবাদের আমিরপেটের মতো এলাকাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা প্রযুক্তিগত দক্ষতা শিখতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ক্লাসরুম ভরিয়ে ফেলত।
ঐতিহ্যগতভাবে, আমিরপেটের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো মাইক্রোসফট অফিস এবং জাভার মতো প্রোগ্রামিং ভাষার কোর্স অফার করত। কিন্তু এখন এই কেন্দ্রগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে এআই প্রশিক্ষণের দিকে ঝুঁকছে।
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে এক আলোচনায়, সান মাইক্রোসিস্টেমসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিনোদ খোসলা ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সমস্ত আইটি পরিষেবা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে। পরিস্থিতি বেশ বিশৃঙ্খল হতে চলেছে।"