'ডোন্ট ওয়ারি ভিলেজ’: দীর্ঘ কর্মঘণ্টা ও একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে দ.কোরিয়ান তরুণরা ছুটে যান যেখানে

২০১৮ সালের দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে থাকতেন কিম জি-উং। বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়। অবিবাহিত এই বিক্রেতার বেশিরভাগ সময় কেটে যেত অফিসে বা অফিসে কিংবা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে গুটিসুটি মেরে।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন সকালে কাজে যাওয়ার পথে আমি মৃত্যুর কথা ভাবতাম।'
কিমের সবচেয়ে কষ্ট হতো একাকিত্বে।'আমার কথা বলার মতো কেউ ছিল না। অফিস থেকে ফিরে একা একা টিভির চ্যানেল পাল্টাতাম না হয় ভিডিও গেম খেলতাম,' বলেন তিনি।
অফিসে সম্পর্ক তৈরি করতে না পেরে কিম ধীরে ধীরে আরও হতাশ ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন। এমন সময় তার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কর্মস্থলেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান।
'তখনই আমি সত্যি সত্যি নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করি: তাহলে পরের জন কি আমি হবো?' বলেন কিম।
সেই মুহূর্তেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর একটি নেন কিম—ব্যাগ গুছিয়ে সিউল ছেড়ে চলে যাওয়ার। ৯৬ লাখ মানুষের এই শহরই তাকে ক্যারিয়ার গড়ার সর্বোচ্চ সুযোগ আর স্থিতিশীল বেতনের নিশ্চয়তা দিতে পারত, তবু একাকিত্বের দমবন্ধ করা এই জীবন থেকে মুক্তি পেতেই তিনি বিদায় নেন।

রাজধানী সিউলের জনসংখ্যা ১৯৯২ সালে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৯৭ লাখে পৌঁছালেও পরবর্তী কয়েক দশক ধরে তা ক্রমাগত কমছে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন নীতিনির্ধারকরা। ১৯ থেকে ৩৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৬ সালে যেখানে এ বয়সী জনগোষ্ঠী ছিল ৩১ লাখ ৮০ হাজার, সেখানে ২০২৩ সালে তা নেমে এসেছে ২৮ লাখ ৬০ হাজারে।
যদিও উচ্চ বেতনের করপোরেট চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিউল এখনও অনেকেরই কাছে আকর্ষণীয়, তবে আদমশুমারির তথ্য বলছে—শহরটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে ধরে রাখতে পারছে না। গত এক দশকে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ সিউলে এসেছেন, আবার ছেড়েও গেছেন।
কোরিয়ান তরুণদের জন্য সিউল অনেকটাই ভিন্ন অভিজ্ঞতা। বাড়ি কেনার সামর্থ্য না থাকা, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা আর তুলনামূলক কম বেতনে তারা হতাশ। রাজধানীর 'বেঁচে থাকার জন্য কাজ' সংস্কৃতিকে তারা বলেন 'হেল জোসন'—যা প্রাচীন কোরিয়ান রাজ্যের সঙ্গে আজকের বাস্তবতার বৈপরীত্যকে ইঙ্গিত করে।
জনসংখ্যাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান পেনিনসুলা পপুলেশন ইনস্টিটিউট ফর ফিউচারের গবেষক ইউ হ্যে-জং বলেন, 'আমাদের সমাজের চাকরির সংস্কৃতি বেশ কুখ্যাত। এতে কর্মীদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়, সন্তান জন্মের পর নারীরা নিজেদের ক্যারিয়ার হারান, আর পুরুষদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।'
ইউ বলেন, 'সিউলে বাড়ি এবং শিশুর শিক্ষা খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ায় পরিবারগুলোর জন্য স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।' তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবন একসাথে মেলানো প্রায় অসম্ভব।
'ডোন্ট ওয়ারি ভিলেজ'
কিমের জন্য সিউল ছাড়ার সুযোগটা আসে হঠাৎই। অনলাইনে তিনি দেখতে পান 'ডোন্ট ওয়ারি ভিলেজ'-এর গেটওয়ে প্রোগ্রামের একটি বিজ্ঞাপন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মকপো শহরে গড়ে ওঠা এই গ্রামে রয়েছে বহু পরিত্যক্ত ভবন। এখানেই শুরু হয়েছিল এক ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ, যার উদ্যোক্তা ছিলেন আরেকজন সিউল ত্যাগী—হং ডং-জু।
সিউলের অভিজাত দেইচি-ডং এলাকায় বড় হওয়া হংয়ের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজধানীর শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, এরপর করপোরেট চাকরি—সবই ছিল হাতের নাগালে।
কিন্তু ২০ বছর বয়সেই হং বুঝতে পারেন, এ পথ তার জন্য নয়। 'সিউলে বসে উচ্চ বেতনের চাকরি করাটাই আমার জীবনের লক্ষ্য নয়,' বলেন এখন ৩৮ বছর বয়সী হং। 'আমি চাইনি প্রতিদিন দীর্ঘ সময় অফিসে কাটাতে।' তাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই তিনি অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নেন—শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার।

পরে হং তৈরি করেন 'ডোন্ট ওয়ারি ভিলেজ'-এর পরিকল্পনা। এ সময় তিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালাতেন, যেখানে শত শত তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তারা সবাই ভাগ করে নিতো করপোরেট চাপ, একাকীত্ব আর সংগ্রামের গল্প।
হং বলেন, 'আমাদের গ্রামের নকশা এমনভাবে করা হয়েছিল, যেন শহরতলির ভেতরে একটি কমিউনিটি তৈরি হয়—যা অনেকের জীবনে নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'কিছুটা এমনই মনে হতো যে, আমি এমন সব মানুষদের জন্য আশ্রয় তৈরি করছি, যাদের সমাজে কোথাও জায়গা দেওয়া হয়নি।'
হং-এর জীবনও পুরোপুরি বদলে গেছে।
সিউলে থাকাকালীন তিনি বিবাহের ব্যাপারে বেশি ভাবতেন না। কিন্তু মকপোতে তিনি পরিচয় পান সেই মহিলার সঙ্গে, যিনি পরে তার স্ত্রী হন। এখন তিনি একজন পিতাও।
হং বলেন, 'সিউলে একজনকে কোম্পানি, জীবিকা আর সমাজের জন্য নিজের জীবন অনেক কিছু উৎসর্গ করতে হয়। কিন্তু মকপোতে আমি আমার সময় নিজেই নিয়ন্ত্রণ করি। যে কাজ করতে চাই, করতে পারি, আর অর্থ নিয়ে আমি এখন ভয় পাই না।'
ডোন্ট ওরি ভিলেজের আরও দুই বাসিন্দা— পার্ক মিউং-হো ও কিম মিন-জি দম্পতিও সিউলের লাভজনক চাকরি ছেড়ে মকপোতে শান্ত ও শিথিল জীবন বেছে নিয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার জানে, সিউলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর কঠোর কর্মসংস্কৃতি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সমাধানে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত বছর চালু হয় 'সিউল উইদাউট লোনেলিনেস' পরিকল্পনা। আগামী পাঁচ বছরে এ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা হবে ৪৫১.৩ বিলিয়ন ওন (৩২২ মিলিয়ন ডলার)। এর আওতায় চালু হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মানসিক সহায়তা হটলাইন এবং কমিউনিটি সেন্টার—'সিউল মেয়ুম কনভিনিয়েন্স স্টোরস'। এখানে মানুষ পরামর্শ নিতে পারেন, আবার চাইলে বিনামূল্যে রামেন নুডলসও খেতে পারেন।
শহরের একক বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ 'ডেট নাইট' প্রচার করছে প্রশাসন। পাশাপাশি জন্মহার কমে যাওয়ায়—যা এখন বিশ্বের সর্বনিম্ন—নতুন দম্পতি ও নবজাতকের অভিভাবকদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজও দেওয়া হচ্ছে।
সরকার এমনকি সিউলের বাইরেও সমাধান খুঁজছে।