পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্পের কাছে জেলেনস্কি ও ইউরোপের দাবি কী?

ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, যেন তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকটি কাজে লাগিয়ে মস্কোর ওপর চাপ বাড়ান। এর কারণ হলো ইউক্রেনের জন্য গ্রহণযোগ্য শর্তে যুদ্ধ শেষ হয়।
তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ট্রাম্প শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলেছেন, পক্ষগুলো একটি চুক্তির কাছাকাছি রয়েছে, যা সংঘাতের সমাধান আনতে পারে। ট্রাম্প সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি, আর তাকে বলব, তোমাকে এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে। শেষ করতেই হবে।'
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, সমঝোতার জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়কেই কিছু জমি ছাড়তে হবে। তার ভাষায়, 'কিছু জমি বিনিময় হবে।' অতীতে তিনি এমন সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, তবে এখন পর্যন্ত রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে জমি ছাড়তে রাজি হয়নি।
ইউরোপীয় নেতাদের আশঙ্কা, রাশিয়াকে বড় ছাড় দিলে ভবিষ্যতে অঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ১৩ আগস্ট বুধবার বড় কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের নেতা প্রথমে নিজেদের মধ্যে এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করছেন। এরপর তারা ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে কথা বলবেন।
ইউক্রেনকে আলোচনায় রাখা
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জেলেনস্কি বলেন, তিনি আলাস্কার সম্মেলনে থাকবেন না। এটি হবে ২০১৮ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প ও পুতিনের মুখোমুখি বৈঠক, যখন দুজনই ক্ষমতায় আছেন। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, এর পর একটি 'ত্রিপক্ষীয় বৈঠক' হবে, যেখানে ট্রাম্প ও পুতিন দুজনই থাকবেন। যদিও এখন পর্যন্ত পুতিন তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি নন।
জেলেনস্কি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি একজন মধ্যস্থতাকারী; তিনি মাঝখানে আছেন, রাশিয়ার পক্ষে নন। তিনি আমাদের পক্ষেও না থাকুন, তবে মাঝখানে থাকুন।'
৯ আগস্ট ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় কমিশনের নেতারা ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। তারা বলেন, 'ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি আমাদের অটল অঙ্গীকার আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি।' বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেনে শান্তির পথ নির্ধারণ করা যাবে না।'
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্জ বুধবার এক ভিডিও কলে ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স, জেলেনস্কি ও কয়েকজন ইউরোপীয় নেতাকে যুক্ত করে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনা করবেন। মের্জ বলেন, 'আমরা মেনে নিতে পারি না যে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ভৌগোলিক ইস্যু ইউরোপীয় ও ইউক্রেনীয়দের মাথার ওপর দিয়ে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হবে।'
ইইউ-এর শীর্ষ কূটনীতিক কায়া কাইয়াস ১০ আগস্ট বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা আছে রাশিয়াকে সিরিয়াস আলোচনায় বসাতে বাধ্য করার।' তবে তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যেকোনো চুক্তিতে অবশ্যই ইউক্রেন ও ইইউকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কারণ এটি শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়।
আগে যুদ্ধবিরতি
গত সপ্তাহে পুতিন ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের মতে, এতে শর্ত ছিল ইউক্রেনকে পূর্বাঞ্চলের ডোনেৎস্ক অঞ্চলের পুরোটা রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে। ওই অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখনো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে।
৬ আগস্ট পুতিন এই প্রস্তাব মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের হাতে দেন। পরে ইউরোপীয় নেতারা ও ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্রিটেনে বৈঠকে বিকল্প প্রস্তাব দেন। তাদের পরিকল্পনায় রাশিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং বলা হয়—যেকোনো আলোচনা শুরুর আগে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে হবে। জমি বিনিময় হলে তা অবশ্যই পারস্পরিক হতে হবে এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ন্যাটো সদস্যপদসহ গ্যারান্টি থাকতে হবে।
ইউক্রেন বরাবরই বলেছে, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তির আগে যুদ্ধ থামা জরুরি। কিন্তু রাশিয়ার শর্ত, যুদ্ধবিরতির আগে বড় আকারের শান্তিচুক্তি হতে হবে।
জেলেনস্কির আরও বক্তব্য
গত সপ্তাহে জেলেনস্কি বলেন, 'রাশিয়ার অপরাধের জন্য আমরা তাকে কোনো পুরস্কার দেব না। ইউক্রেনীয়রা তাদের জমি দখলদারের হাতে তুলে দেবে না।' তিনি আরও জানান, তার সাংবিধানিক ক্ষমতা নেই জমি বিনিময়ের অনুমোদন দেওয়ার। ১৯৯১ সালের সীমান্ত পরিবর্তন ইউক্রেনের সংবিধানের বিরোধী।
সোমবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, 'পুতিন নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধবিরতি বা যুদ্ধ শেষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন না। বরং তারা সেনা ও অস্ত্র পুনর্বিন্যাস করছে, যা নতুন আক্রমণের প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়।'
ট্রাম্পের আরও বক্তব্য
সোমবার ট্রাম্প জেলেনস্কির সমালোচনা করে বলেন, তিনি ইউক্রেনের জমি ছাড়তে অনীহা দেখিয়ে ভুল করছেন এবং এ বিষয়ে তার সঙ্গে 'খুবই গুরুতর' মতপার্থক্য রয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, 'আমার ধারণা জমি বিনিময় ইউক্রেনের জন্য ভালো হবে। এই চুক্তিতে উভয় পক্ষের জন্য ভালো ও খারাপ দুই ধরনের দিক থাকবে। সীমারেখা জটিল, তাই কিছু জমি বদল হবে।'
তিনি আরও বলেন, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের প্রথম দুই মিনিটেই বুঝে যাবেন চুক্তি সম্ভব কি না। 'শেষ পর্যন্ত আমি দুজনকে এক কক্ষে বসিয়ে দেব, আমি থাকি বা না থাকি, এবং আমার মনে হয় বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে,' বলেন ট্রাম্প।