কাতারের দেওয়া বিমান ৬ মাসেই এয়ার ফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহার উপযোগী হবে: দাবি ট্রাম্পের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কাতার থেকে উপহার পাওয়া একটি বিমান ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তাকে বহনকারী 'এয়ার ফোর্স ওয়ান' হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। বোয়িংয়ের কাছ থেকে দুটি নতুন প্রেসিডেনশিয়াল বিমান পাওয়ার কথা থাকলেও, সেই প্রক্রিয়া দীর্ঘ বিলম্বের মুখে পড়েছে। তার আগেই এই বিমানটি প্রস্তুত হবে বলে দাবি ট্রাম্পের।
জুলাইয়ের শেষে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, "ওরা বলছে ফেব্রুয়ারিতেই হয়ে যাবে। অন্যগুলোর চেয়ে অনেক আগে। অন্য বিমানগুলো তো এখনো তৈরিই হচ্ছে।"
কিন্তু সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ও বিমান বিশ্লেষকরা এই সময়সীমা নিয়ে ঘোর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, একটি বিদেশি বিমানকে এয়ার ফোর্স ওয়ানের মতো বিশেষ নিরাপত্তা চাহিদা পূরণের উপযোগী করে তোলা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রেসিডেন্টের জন্য, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য, বিমানটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত কি না, তা নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়।
বাইডেন প্রশাসনের অধীনে বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারী সচিব ছিলেন অ্যান্ড্রু হান্টার। তিনি এয়ার ফোর্স ওয়ানসহ শত শত ক্রয় প্রকল্পের জন্য ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বাজেট তদারকি করতেন। তার মতে, প্রেসিডেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু শর্ত যদি ট্রাম্প মওকুফ না করেন, তবে এই সময়ের মধ্যে বিমানটি প্রস্তুত করা ''চ্যালেঞ্জিং, এমনকি অসম্ভবও হতে পারে।"
তিনি বলেন, "বোয়িংয়ের প্রোগ্রামে যে সময় লাগছে, তার চেয়ে কম সময়ে কাতারের বিমানে এয়ার ফোর্স ওয়ানের সব সুবিধা যুক্ত করা সম্ভব নয়।"
সময়সীমার উদ্বেগ ছাড়াও, কাতার থেকে বোয়িং ৭৪৭-৮ মডেলের বিমানটি উপহার হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে এবং এটি নিয়ে দুই দলেই সমালোচনা হচ্ছে। অনেকে এমন উপহার গ্রহণের বৈধতা ও নৈতিকতা নিয়ে সন্দিহান। আবার অনেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য একটি বিমান প্রস্তুত করতে যে পরিমাণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হয়, তা নিয়ে চিন্তিত।
তবে এসব উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে ট্রাম্প এই পরিকল্পনার সময়সীমা নিয়ে বেশ আশাবাদী। জুলাইয়ের শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "বোয়িংয়ের বিমানগুলোর চেয়ে এটি আমরা দেড় থেকে দুই বছর আগেই পেয়ে যাব।"
এদিকে, চুক্তিবদ্ধ বোয়িংয়ের বিমান দুটির সংস্কার কাজ স্যান অ্যান্টোনিওতে চলছে। কাতারের বিমানটিও আগে আপগ্রেডের জন্য এই শহরেই রাখা ছিল। তবে এয়ারক্রাফট ট্র্যাকার 'এডিএস-বি এক্সচেঞ্জ' এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি ২৯ জুন ফোর্ট ওয়ার্থ অ্যালায়েন্স বিমানবন্দরে উড়ে যায়। এরপর থেকে এটিকে খুব কমই ট্র্যাকারে দেখা গেছে।
এত তাড়াতাড়ি কি সম্ভব?
সাধারণ বাণিজ্যিক বিমানের সংস্কার করতেই কয়েক সপ্তাহ বা মাস লেগে যায়, যেখানে এয়ার ফোর্স ওয়ানের মতো কঠোর ও জটিল নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তার কারণে কাতারের বিমানটির ক্ষেত্রে এর চেয়েও কঠোর পরীক্ষার প্রয়োজন হবে এবং এতে আরও বেশি সময় লাগার সম্ভাবনা প্রবল।
বিমান ও প্রতিরক্ষা খাতের পরামর্শক সংস্থা 'অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরি'-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিচার্ড আবলাফিয়া বলেন, বিমানটি ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রস্তুত হতে পারে, তবে এয়ার ফোর্স ওয়ানের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বা নিরাপত্তা ছাড়াই। তার আশঙ্কা, এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে প্রশাসন হয়তো কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে পারে।
তিনি ব্যাঙ্গ করে বলেন, "ফেব্রুয়ারিতে ওড়ার জন্য এটি একদম প্রস্তুত হয়ে যাবে, আর এর ভেতরের সব কথাবার্তা বিশ্বের যে কারও কাছে সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকবে।"
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্ধু রাষ্ট্র হলেও অন্য কোনো সরকারের কাছ থেকে পাওয়া একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড বিমানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও যোগাযোগ সরঞ্জাম স্থাপন করা এক বিশাল কাজ। মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে এর জন্য বিমানটির কাঠামো পর্যন্ত খুলে ফেলে নতুন করে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি করতে হবে।
বাইডেন প্রশাসনের বিমানবাহিনীর সচিব ফ্র্যাঙ্ক কেন্ডাল বলেন, বিমানে যত বেশি পরিবর্তন আনা হবে, সেটির উড্ডয়ন যোগ্যতা নিশ্চিত করতে তত বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে, আর এতে সময়ও বেশি লাগবে।

তবে অন্য বিশেষজ্ঞদের মতো কেন্ডালও মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে বিমানটি প্রস্তুত করা সম্ভব, "যদি প্রেসিডেন্ট এয়ার ফোর্স ওয়ানের প্রায় সমস্ত বিশেষ প্রয়োজনীয়তা মওকুফ করেন এবং বিমানে ন্যূনতম পরিবর্তন আনেন।" তিনি আরও বলেন, "এর ফলে এমন একটি বিমান তৈরি হবে যা সম্ভবত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই ব্যবহার করা যাবে।"
নতুন এয়ার ফোর্স ওয়ানের দীর্ঘ প্রতীক্ষা
প্রেসিডেন্টের ব্যবহৃত কয়েক দশক পুরোনো বিমানগুলো প্রতিস্থাপনের আলোচনা শুরু হয়েছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বোয়িংয়ের কাছ থেকে দুটি বিমান কেনার চুক্তির মাধ্যমে এতে গতি আসে। কিন্তু কাতারের রাজপরিবারের উপহার দেওয়া একটি বিমানের সংযোজন এই কাহিনীতে এক আজব ও উদ্বেগজনক মোড় যোগ করেছে।
২০১৮ সালে বোয়িং জানায়, তারা দুটি নতুন প্রেসিডেন্সিয়াল বিমানের জন্য ৩.৯ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি পেয়েছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে নতুন বিমান প্রস্তুত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়সীমা পূরণ না হওয়ায় ট্রাম্প একটি বিকল্প পথের সন্ধান করেন।
ট্রাম্প বলেছেন, "বিনামূল্যে পাওয়া এত দামী একটি বিমান" প্রত্যাখ্যান করা বোকামি হবে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানটির সংস্কারেই কয়েকশ মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। যখন এই সংস্কারের খরচ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, ট্রাম্প বিষয়টি এড়িয়ে যান। আনুষ্ঠানিকভাবে, বিমানটি সংস্কারের খরচ গোপনীয়, তবে বিমানবাহিনীর সচিব ট্রয় মেইঙ্ক জুনে আইন প্রণেতাদের বলেছিলেন যে এর জন্য সম্ভবত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কম খরচ হবে।
বোয়িংয়ের দুটি এয়ার ফোর্স ওয়ান প্রতিস্থাপনের চুক্তির মূল সময়সীমা ছিল ২০২২ সাল, কিন্তু এখন বিমানগুলো ২০২৭ সালের মধ্যে সরবরাহ করা হতে পারে। এই বিলম্বের কারণেই ট্রাম্প বিকল্প খুঁজছেন। তবে কেন্ডালের মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন প্রেসিডেন্টের বিমান তৈরির প্রশ্ন আসে, তখন খরচ বা গতির চেয়ে নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকেই সবার আগে রাখা উচিত।