ডিপসিকের সাফল্যের ছয় মাসে এআই খাতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে চীন

সবুজে ঘেরা হাংজুর উপশহর লিয়াংঝু এখন চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঝেজিয়াং প্রদেশের প্রযুক্তিনির্ভর রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই এলাকা বহুদিন ধরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে—বিশেষ করে এখানে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে চীনা সভ্যতার প্রাচীনতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এখন এই ঐতিহাসিক স্থানটিই গড়ে উঠছে ভবিষ্যৎমুখী প্রযুক্তিনির্ভর চীনের প্রতীক হিসেবে।
সারা দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা ভিড় জমাচ্ছেন লিয়াংঝুতে। তাদের লক্ষ্য, এআই খাতের উদীয়মান উদ্যোক্তা পাশাপাশি অ্যাপ প্রকৌশলী ও উন্নয়নকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা; বিশেষ করে তাদের সাথে যারা ভবিষ্যতের প্রযুক্তিকে ঘিরে বড় স্বপ্ন দেখে।
মাত্র ছয় মাস আগেও 'ডিপসিক' নামটি অনেকের কাছে অচেনা ছিল। কিন্তু এই স্টার্টআপ অল্প খরচে শক্তিশালী ওপেন সোর্স এআই মডেল তৈরি করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে, যা বিলাসবহুল ও উন্নত দেশের মডেলগুলোর তুলনায় সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী—যা প্রদেশটির অন্যতম প্রযুক্তিকেন্দ্র এবং লিয়াংঝুর কাছাকাছি অবস্থিত।
আজ লিয়াংঝু চীনের পূর্ণাঙ্গ এআই ইকোসিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট—তারা বিশ্বাস করে, খুব শিগগিরই এ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে দেশটি।
গত মাসেই তিনটি চীনা গবেষণাগার বিশ্বমানের 'লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল' (বৃহৎ ভাষা মডেল) প্রকাশ করেছে, যা বিশ্বের সেরা মডেলগুলোর মধ্যে ধরা হচ্ছে।
লিয়াংঝুর একজন প্রাথমিক পর্যায়ের বিনিয়োগকারী বলেন, 'এআই এখন ব্যবহারযোগ্যতার গুরুত্বপূর্ণ সীমা অতিক্রম করেছে।' তিনি জানান, এখন বড় ধরনের এআই প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, 'যখন পানি ফুটে ওঠে, তখন অনেকেই বাষ্প ইঞ্জিন বানাতে চায়।'
টেনসেন্ট এবং দুটি রাইড-শেয়ারিং কোম্পানিতে কাজ করার পর সাম হু নামের এক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে একটি এআই এজেন্ট তৈরির কাজ শুরু করেন, যা ব্যবস্থাপকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। তিনি সময়কে অনুকূল মনে করে বলেন, 'এটা এমন এক সময়, যখন ভুল করলেও খরচ তুলনামূলকভাবে কম।'
হু এবং তার সহকর্মীদের জন্য চীনের এআই খাতে বিশাল সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। মরগান স্ট্যানলির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে চীনের এআই শিল্পের বাজারমূল্য ছিল ৩.২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়াবে ১৪০ বিলিয়ন ডলারে। আর এআই সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও উপাদান সরবরাহকারীদের অন্তর্ভুক্ত করলে এই পরিসর দাঁড়ায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গার্টনার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুনে গ্রেটার চীনের মাত্র ৮ শতাংশ কোম্পানি জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করত। এক বছরেরও কম সময়ে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে।
যদিও প্রাথমিক উত্তেজনা কিছুটা কমেছে, 'ডিপসিক' এর মডেল এ খাতে দৃষ্টিভঙ্গির বড় পরিবর্তন এনেছে। অনেকেই এখনো অভিযোগ করেন, এআই মডেলগুলো মাঝে মাঝে 'ভুল' বা 'হ্যালুসিনেশন' করে। তবুও ডিপসিকের সাফল্য খরচ কমিয়েছে এবং চীন এখন প্রতিযোগিতা বা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি উন্নয়নের বদলে বাস্তব ব্যবহারিক দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে—ব্যবসা, শিল্প, সরকার এমনকি সমাজজুড়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এআইকে গ্রহণ, অভিযোজন ও বিস্তারের মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই প্রচেষ্টায় চীনা সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন 'ডিপসিক' এর প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং-এর সঙ্গে করমর্দন করেন, সেই দৃশ্য দেশজুড়ে সম্প্রচারিত হয়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এআই নিয়ে আগ্রহ বেড়ে যায়। এমনকি অনেক বয়স্ক মানুষও চ্যাটবট ব্যবহার করে দেখেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এআই কোর্স চালু করতে হচ্ছে অভিভাবকদের চাপে। লুইস ডং বলেন, 'শুরুর উত্তেজনার পর এখন ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।' বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুত ব্যবহার শুরু করাই সাফল্যের চাবিকাঠি—আর 'ডিপসিক'সহ অন্যান্য মডেলের উন্নয়ন এ পথকে আরও সহজ করেছে।
চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এআই প্রযুক্তি নিয়ে নতুন উদ্যমে গবেষণায় মনোযোগী। যদিও এখনো অনেক উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে। অ্যাকসেনচারের এক জরিপ বলছে, ৪৬ শতাংশ চীনা কোম্পানি বড় পরিসরে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছে, তবে মাত্র ৯ শতাংশ ইতিবাচক উৎপাদনশীলতা বা মুনাফার প্রভাব পেয়েছে।
এআই খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, সবকিছু এখনো শুরুর পর্যায়ে। ইয়িজি ইন্টেলিজেন্স-এর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা জিয়াং শিংহুয়া জানান, ফার্মেসি, ফার্নিচার দোকান ও বিউটি ব্র্যান্ডের জন্য এআই-ভিত্তিক কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট ও লাইভস্ট্রিমার তৈরি করার পর ক্রেতারা আগ্রহ দেখিয়েছেন। এমনকি ছোটখাটো ভুল হলেও তা গ্রহণ করছেন তারা।
চীনা প্রযুক্তিবিদদের মতে, এআই পণ্যে উন্নতির সম্ভাবনা বিশাল। তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা। গত এপ্রিল মাসে ট্রাম্প প্রশাসন চীনে এনভিডিয়ার এইচ২০ চিপ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। যদিও এটি প্রশিক্ষণে সীমিত, তবুও এআই মডেল পরিচালনায় কার্যকর। চিপ না পাওয়ায় চীনের নতুন মডেল প্রশিক্ষণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান কিছুটা শিথিল করলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
তবুও চীনের এআই উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। গত মাসে সাংহাইয়ে আয়োজিত দেশের বৃহত্তম এআই সম্মেলনে মিনিম্যাক্সের প্রধান ইয়ান জুনজিয়ে জানান, সেরা মডেলগুলোর ইনফারেন্স খরচ 'এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেছে'। তাঁর ধারণা, আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে উদ্ভাবন ও অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার কারণে খরচ আরও কমবে। জিয়াং জানান, যুক্তরাষ্ট্রের জিপিটি বা জেমিনির মতো উন্নত বিদেশি মডেল ব্যবহার করতে না পারলেও চীনা ওপেন সোর্স মডেল দ্রুত উন্নতি করছে।
শুধু প্রযুক্তি উন্নয়ন নয়, চীন চাহিদা তৈরিতেও সক্রিয়। এপ্রিল মাসে চীনা নেতৃত্ব এআই-সংক্রান্ত স্টাডি সেশন আয়োজন করে, যেখানে শি জিনপিং বলেন, চীনকে রাষ্ট্রনির্ভর সামষ্টিক সংগঠনের সুবিধা ('জুগুও তিজি ইয়োউশি') কাজে লাগাতে হবে।
নিচের স্তরের সরকারগুলো, যাদের ওপর থেকে দেওয়া নির্দেশ মানার অভ্যাস, তারা এখন এআই-ভিত্তিক নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগ খুঁজছে। উদাহরণস্বরূপ, হাংঝৌভিত্তিক স্টার্টআপ 'রোকিড' যখন এআই চশমা তৈরিতে ভর্তুকির আবেদন করে, মাত্র ৮ মিনিটেই তাদের অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ ইউয়ান জমা পড়ে। বিভিন্ন শহর এখন আবাসন, কম্পিউটিং শক্তি ও ওপেন-সোর্স মডেল তৈরিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্র নিজেও বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে—জাদুঘরগুলো ট্যুরে, বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো লাইনে ত্রুটি শনাক্তে 'রোকিড'র চশমা ব্যবহার করছে।
পৌর ও প্রাদেশিক সরকারগুলো 'ডিপসিক' ব্যবহার করছে হটলাইন উন্নয়ন, তথ্য বিশ্লেষণ ও নীতিমালা ব্যাখ্যায়। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেন ইয়াং জানান, তিনি এবার যতটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দিয়েছেন, তা গত বছরের দ্বিগুণ। বেইজিংয়ের হাইডিয়ান জেলা শিক্ষকদের পাঠ প্রস্তুতিতে এআই ব্যবহার করছে, জিয়াংসি প্রদেশ এআই একীভূত করতে চাচ্ছে তাদের বিরল খনিজ ও সিরামিক শিল্পে।
সরকার ও বিনিয়োগকারীরা যদি খুব দ্রুত এগিয়ে আসে, তখন অনেক ঝুঁকি তৈরি হয়। বিনিয়োগ ব্যাংক জেফারিজের বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন যে 'হিউম্যানয়েড রোবট' নিয়ে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তা এমন একটা 'বায়ু বুদবুদ' হতে পারে—যা পরে ফেটে যেতে পারে।
অতিরিক্ত ব্যবহারে ঝুঁকিও বাড়তে পারে। এপ্রিল মাসে ছিংহুয়া গবেষকেরা প্রশ্ন তোলেন—চীনের ৩০০-এর বেশি হাসপাতালে 'ডিপসিক' ব্যবহারের ক্ষেত্রে কি তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে? এতে কি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে না?
গত মাসে আরেকদল গবেষক সতর্ক করে বলেন, হাসপাতালে এআই ব্যবহার নিরাপদ ও দায়িত্বশীলভাবে হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা জরুরি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও এখন এসব ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন। শি জিনপিং সম্প্রতি বলেছেন, এআই, কম্পিউটিং ও বৈদ্যুতিক যানবাহন খাতে স্থানীয় সরকারগুলো অত্যধিক মনোযোগ দিচ্ছে। তাঁর প্রশ্ন, 'প্রতিটি প্রদেশ কি এসব শিল্পেই উন্নয়ন ঘটাবে?'—উত্তর, 'না'।
তবে এই প্রশ্ন সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারগুলোর সক্রিয়তা প্রমাণ করে, চীনের এআই যাত্রা আর থেমে থাকছে না।