সূর্যের আলো যেভাবে ভ্যাম্পায়ারদের শত্রু হয়ে উঠল

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচলিত লোককথা, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও টিভি শো-র কল্যাণে ভ্যাম্পায়ারদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আমাদের কল্পনায় গভীরভাবে গেঁথে গেছে: এই প্রাণীরা রক্ত পান করে, কফিনে ঘুমায়, রসুন ও ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি থেকে একশো হাত দূরে থাকে এবং হৃৎপিণ্ডে কাঠের গোঁজ বিঁধলে তাদের মৃত্যু হয়। তবে ভ্যাম্পায়ারের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো, তারা রাতের আঁধারের জীব এবং দিনের আলো সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় এমন ছিল না। কিছু ভ্যাম্পায়ার গল্পে এর ঠিক উল্টো চিত্রও দেখা যায়। ওইসব গল্পে এমন এক ধরনের সত্তার কল্পনা করা হয়েছে, যারা দিনের আলোয় স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে। এদের বলা হয় 'ডে-ওয়াকার'। ভ্যাম্পায়ারদের জগতে ডে-ওয়াকারের ধারণাটি নতুন ও পুরনো দুই-ই। গল্পের প্রয়োজনে এই জীবকে কতটা বিচিত্র রূপে উপস্থাপন করা সম্ভব, তার প্রমাণ এই ধারণা।
নাইটওয়াকারদের উৎপত্তি
ভ্যাম্পায়ারদের নিয়ে লোককথা বেশ সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যময় এবং অত্যন্ত প্রাচীন। লোকগাথা এবং অন্ধকার ও রাতের সঙ্গে এই প্রাণীর সম্পর্ক বহু প্রাচীন।
মানুষ একে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহারও করেছে। নিউইয়র্ক সিটি কলেজ অভ টেকনোলজির গথিক সাহিত্যের অধ্যাপক লরা ওয়েস্টেনগার্ড বলেন, 'বিশেষ করে চীনে এমন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে, আপনি যদি বাড়ির সামনে এক ব্যাগ চাল রেখে দেন এবং চীনা পুরাণের ভ্যাম্পায়ার সেই চালের ব্যাগ দেখতে পায়, তবে সে মোহাবিষ্ট হয়ে প্রতিটি দানা গুনতে শুরু করবে। আর এর মধ্যেই যে সূর্য উঠে যাবে, তা সে খেয়ালই করবে না।'
তবে উনিশ শতকে পশ্চিমা ইউরোপীয় সাহিত্যে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে যে জোয়ার আসে, তার অনেক ভ্যাম্পায়ারই দিনের আলোতে চলাফেরা করতে পারত। জন পলিডোরির ১৮১৯ সালের 'দ্য ভ্যাম্পায়ার', জোসেফ শেরিডান লে ফানুর ১৮৭২ সালের 'কারমিলা', এমনকি ব্রাম স্টোকারের ১৮৯৭ সালের 'ড্রাকুলা'র ভ্যাম্পায়াররাও দিনের বেলায় দুর্বল হয়ে পড়ত বটে, কিন্তু তারা দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে যেত না। 'তারা ঘুমাতে পছন্দ করত, কিন্তু সূর্যের আলোয় পুড়ে ছাই হয়ে যেত না,' বলেন ওয়েস্টেনগার্ড।
বয়ানের এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এফ. ডব্লিউ. মুরনাউয়ের ১৯২২ সালের নির্বাক জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র 'নোসফেরাতু'র। ছবিটি স্টোকারের 'ড্রাকুলা' দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হলেও এতে একটি বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল—সিনেমাটির শেষে খলনায়ক কাউন্ট অরলক উদীয়মান সূর্যের আলোয় আটকা পড়ে এবং সামান্য আগুনেই বিলীন হয়ে যায়।

ইউনিভার্সিটি অভ ভার্জিনিয়ার সহকারী অধ্যাপক স্ট্যানলি স্টেপানিক বলেন, 'ওই সিনেমা থেকেই এর শুরু, মুরনাউয়ের আনা ছোট্ট একটা পরিবর্তন থেকে, যা সিনেমার মাত্র তিন সেকেন্ডের একটি দৃশ্য ছিল।' মুরনাউ কেন এমনটি করেছিলেন তা জানা যায়নি, তবে তার এই সংযোজনটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। স্টেপানিক আরও বলেন, 'লোককথার এই পরিবর্তনটি ঠিক সেখানেই ঘটে। এরপর থেকে আমরা একে একটি বড় থিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি।"
ডে-ওয়াকাররা যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল
১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে সূর্যের আলোতে ভ্যাম্পায়ারদের দুর্বলতার ধারণা জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে এতটাই গেঁথে যায় যে, রে-ব্যান তাদের একটি বিজ্ঞাপনে এটিকে রকতার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে। বিজ্ঞাপনটিতে তাদের ব্র্যান্ডের সানগ্লাস পরা স্টাইলিশ ভ্যাম্পায়ারদের দেখানো হয়। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে গল্প লিখতে গেলে লেখকরা এই বৈশিষ্ট্যের ধারণা নিয়েই কাজ করতে বাধ্য হতেন; একটা জুতসই ব্যাখ্যাও দিতে হতো তাদের। যেমন টোয়াইলাইট সিরিজের লেখিকা স্টেফানি মেয়ার তার ভ্যাম্পায়ারদের অন্ধকার ও মেঘলা আবহাওয়াপ্রীতির কারণ হিসেবে তাদের চকচকে ত্বক লুকানোর প্রয়োজনীয়তাকে দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু ভ্যাম্পায়ার লোককথার চিরন্তন শক্তির একটা বড় অংশই হলো এর নতুন করে উপস্থাপনের সম্ভাবনা। তাই কিছু গল্পে এমন ভ্যাম্পায়ারের মতো প্রাণীর ধারণা নিয়ে আসা হয়, যারা দিনের বেলাতেও টিকে থাকতে পারে। এর অন্যতম সেরা উদাহরণ হলো ১৯৯৮ সালের যুগান্তকারী সুপারহিরো মুভি 'ব্লেড'।
১৯৭০-এর দশকে মার্ভেলের সুপারহিরো হিসেবে এর যাত্রা শুরু। ব্লেড চরিত্রটি ভ্যাম্পায়ার ও মানুষের মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। কমিকস ও চলচ্চিত্র উভয় সংস্করণেই তার গর্ভবতী মাকে এক ভ্যাম্পায়ারের কামড়ে দেয়। এর ফলে ভ্যাম্পায়ারের কামড়ে তার কোনো ক্ষতি হয় না এবং সে ভ্যাম্পায়ার শিকারে বিশেষভাবে দক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু চলচ্চিত্রে তার ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে বলে জানান স্টেপানিক। তাকে দেওয়া হয় এক অশুভ নাম—ডে-ওয়াকার। শত্রুদের মধ্যে তাকে আরও রহস্যময় করে তোলা হয়।
গল্পে ব্লেডকে এমন এক ভ্যাম্পায়ার সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়, যারা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিভক্ত। একদল হচ্ছে 'পিওরব্লাড' বা বিশুদ্ধ রক্তের ভ্যাম্পায়ার, যারা ভ্যাম্পায়ার বাবা-মায়ের ঘরে জন্মায়; আরেকদল হচ্ছে 'মেইড' ভ্যাম্পায়ার, যারা মানুষ হিসেবে জন্মায় এবং পরে ভ্যাম্পায়ারে রূপান্তরিত হয়। চলচ্চিত্রটির ক্লাইম্যাক্সে দেখা যায়, এক প্রাচীন দেবতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য রহস্যময় আচারে ব্লেডের রক্ত সংগ্রহের মাধ্যমে ভ্যাম্পায়াররা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। দুই জগতের মাঝে আটকে থাকা ব্লেডের এই অস্তিত্বই তাকে এমন এক রহস্যময় ও আকর্ষণীয় চরিত্রে পরিণত করেছে।

ব্লেড দেখায় কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভ্যাম্পায়ারদের গল্পগুলো আরও জটিল প্রেক্ষাপট এবং নতুন কাহিনির মোড় তৈরি করেছে, যা এই মিথলজিকে পাঠক-দর্শকদের কাছে সতেজ ও আকর্ষণীয় করে রাখে।
ডে-ওয়াকার ধারণার নতুন রূপ
ডে-ওয়াকার ধারণাটিকে কেন্দ্র করে তৈরি আরেকটি প্রজেক্ট হলো 'জোম্বিক ৪: ডন অভ দ্য ভ্যাম্পায়ারস'। ডিজনি চ্যানেলের এই ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম কয়েক পর্বে জোম্বি বনাম চিয়ারলিডারদের দেখানো হয়। পরে যুক্ত হয় ওয়্যারউলফ ও এলিয়েনরা। আর এখন যুক্ত করা হচ্ছে ভ্যাম্পায়ারদেরও, তবে একটু অন্যভাবে।
পরিচালক পল হোয়েন বলেন, বিপরীতধর্মী দুটি দলকে নিয়ে তৈরি এই প্রজেক্ট। সেই ধারণা থেকেই এসেছে নাইটওয়াকার বনাম ডে-ওয়াকার।
এই মৌলিক ধারণা থেকে দুটি সমান্তরাল সম্প্রদায় তৈরি করা হয়েছে। হোয়েন জানান, ডে-ওয়াকাররা সূর্যের আলোতে বাস করে, সূর্যকে শ্রদ্ধা করে। তাই তাদের শহরটি কাচ, সুইমিং পুল ও আলো দিয়ে তৈরি। তাদের এমন শক্তি আছে যা দিয়ে তারা শক্তির বল তৈরি, আগুন জ্বালানো বা আতশবাজি তৈরির মতো কাজ করতে পারে। অন্যদিকে ভ্যাম্পায়ারদের রয়েছে বাতাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
যেহেতু ফ্র্যাঞ্চাইজিটি শিশুদের জন্য নির্মিত, তাই এখানে অমরত্ব বা রক্ত পানের কোনো বিষয় নেই। তার বদলে দুটি দলই একই 'ব্লাড ফ্রুট' বা রক্ত-ফল খেয়ে বেঁচে থাকে।
ডে-ওয়াকারের ধারণাকে রক্তস্নাত ও দুর্লঙ্ঘনীয় সংঘাতে ভরপুর জগৎ না দেখিয়ে 'জোম্বিজ ৪' টিম একে ভিন্ন থিমে রূপান্তরিত করেছে।
ভ্যাম্পায়ারের বিবর্তন যেভাবে চলছে
তবে শুধু রাতে ঘোরাফেরা প্রচলিত ভ্যাম্পায়ারের ধারণাও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ধরে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়া রায়ান কুগলারের সফল চলচ্চিত্র 'সিনার্স'-এর কথা। এতে দুই যমজ ভাই একটি পানশালা ও বিনোদন কেন্দ্র চালু করার পর রেমিক নামের এক ভ্যাম্পায়ারের মুখোমুখি হয়। মিসিসিপি ডেল্টার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত থেকে উঠে এসে তাদের প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় ভ্যাম্পায়ারটি। মূল চরিত্রদের শুধু রাতটা পার করতে হবে, তাহলেই বেঁচে যাবে।
ওয়েস্টেনগার্ড ব্যাখ্যা করেন, ভ্যাম্পায়ারের আসলে কোনো একটি নির্দিষ্ট বা আসল সংস্করণ নেই। তবে এটাই ভ্যাম্পায়াকে এত শক্তিশালী করে তোলার অন্যতম কারণ। এ কারণেই এই জীবন্মৃত প্রাণীরা বারবার পপ কালচারে ফিরে আসে।
ভ্যাম্পায়াররা ক্যারিশম্যাটিক, ক্ষমতাশালী ও পরিবর্তনশীলতার প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্য গল্প বলার ক্ষেত্রে বহুমুখী চাহিদা পূরণ করতে পারে। স্টেপানিক বলেন, 'সময়ের সাথে সাথে মিডিয়ায় ভ্যাম্পায়ার এতটাই রূপান্তরিত হয়েছে যে এটি মানব অস্তিত্বের প্রায় যেকোনো কিছুর সাধারণ প্রতীকে পরিণত হয়েছে।' গল্পকাররা তাদের ইচ্ছামতো যেকোনো মাধ্যমে ভ্যাম্পায়ারদের ব্যবহার করতে পারেন। 'এটি মূলত মানবজাতির একটি আয়নায় পরিণত হয়েছে।'