বয়স ৫০, ৬০ বা ৭০ পেরিয়েও যেভাবে সুস্থ থাকতে পারেন
জীবনের ৫০, ৬০ ও ৭০ বছর পেরোনো সময় মানেই শরীরের স্বাভাবিক ক্ষয়পূরণ মেনে চলা। তবে একইসঙ্গে এটি নতুনভাবে বাঁচার সুযোগও যেখানে সচেতন জীবনযাপনই স্বাস্থ্য ধরে রাখার মূল চাবিকাঠি। পুষ্টি, ব্যায়াম এবং সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিলে প্রতিটি দশকেই সুস্থভাবে বাঁচা সম্ভব।
৫০-এর দশকে সুস্থ থাকার কৌশল
মধ্য বয়সে পদার্পণের পর শরীরের কিছু পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়। এসব পরিবর্তন অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং মনে হলেও বয়সজনিত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে নমনীয়তা এবং সেখানে নিজের কিছু নিয়ন্ত্রণও থাকে, বলছেন মায়ো ক্লিনিকের 'রবার্ট অ্যান্ড আরলিন কোগড সেন্টার অন এজিং'-এর পরিচালক নাথান ল্যাব্রাসার।
এই বয়সে শরীরের কোষ ও অণুর স্বাভাবিক ক্ষয় বৃদ্ধি পায়, যা বয়সজনিত নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। একে বলে বায়োলজিকাল এজ, যা আপনার প্রকৃত বয়স নয়, বরং শরীরের ভেতরে চলমান পরিবর্তনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অবস্থা বুঝিয়ে দেয়। টেলোমিয়ার নামের অণু-পর্যায়ের সূচক দিয়ে একে মাপা যায়। এই বায়োলজিকাল বয়সই বলে দেয়, আপনি কতটা ভালো অবস্থায় আছেন, যা শুধু বয়সের বছর গোনার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
এই পর্যায়ে লাইফস্টাইল যেমন ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন বা খাদ্যাভ্যাস বয়সের গতিপ্রকৃতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে।
নারীদের জন্য এই সময় মেনোপজ শুরু হতে পারে, সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে। এর সঙ্গে দেখা দিতে পারে হট ফ্ল্যাশ, মেজাজ পরিবর্তন ও ঘুমের সমস্যা। যৌন ইচ্ছা কমে যেতেও পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেকটাইল ডিসফাংশনের মতো যৌন সমস্যার শুরু হতে পারে এই সময়েই।
কী কী করা জরুরি এই বয়সে?
এই দশকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা সুস্থ জীবনের সময় বাড়াতে সহায়তা করে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ৪০ বছর পেরোনো সবার জন্য বার্ষিক স্কিন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া ৫০ বছর বয়স থেকে কোলোরেকটাল ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, ফুসফুস ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের স্ক্রিনিং করা উচিত।
যুক্তরাজ্যে ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের জন্য এনএইচএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) থেকে একটি ফ্রি হেলথ চেক মেলে, যেখানে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুঁকি পরীক্ষা করা হয়। ৫০ বছর বয়সে পৌঁছালে এনএইচএস থেকে স্তন, গর্ভাশয় ও কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের সুবিধা পাওয়া যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হৃদ্রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টিকর খাবার ও ব্যায়ামের নিয়মিত অভ্যাস। উদ্ভিদভিত্তিক খাবার, সম্পূর্ণ শস্য, স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং লিন প্রোটিনভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
শুধু ব্যায়াম করলেই হবে না—তার মধ্যে যেন রকমভেদ থাকে, যেমন স্ট্যামিনা, কার্ডিও, ফ্লেক্সিবিলিটি ও ব্যালান্স—এই চার দিকেই সমান মনোযোগ দিতে হবে। ল্যাব্রাসারের মতে, শুরু করতে দেরি হয়ে গেছে এমনটা ভাবার কিছু নেই। বরং আপনি যত বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করবেন, এর প্রভাব তত দীর্ঘস্থায়ী হবে।
৬০-এর দশকে সুস্থ থাকার কৌশল
জীবনের ষাট দশক মানেই পরিবর্তনের সময়। কারও জন্য এটা বড় সন্তানদের সংসার গুছিয়ে নেওয়ার সময়, আবার কারও জন্য নতুন স্বাস্থ্য সমস্যার সূচনা। এই বয়সে জীবনযাত্রায় এবং শরীরে নানা পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক।
জীবনকাল যত এগোয়, বয়সজনিত শারীরিক পরিবর্তনের ধরন ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্ন হয়। "আমরা যত বয়সে এগোই, ততই বিভিন্ন রোগের ঝুঁকির মুখে পড়ি—তবে বয়স্কদের মধ্যেও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অনেক ভিন্নতা দেখা যায়," বলেন জন হপকিনস সেন্টার অন এজিং অ্যান্ড হেলথের পরিচালক জেনিফার শ্র্যাক।
এই বয়সে হাঁটা ধীর হতে পারে, পায়ের ব্যথা বা ভারসাম্য হারানোর কারণে। হাড়ের সন্ধিতে ব্যথা বা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে সংক্রমণ হলে সেরে উঠতে সময় লাগে এবং বয়সজনিত নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
স্মৃতিশক্তিরও কিছুটা অবনতি ঘটে। ভুলে যাওয়া বা ধীরগতিতে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এই বয়সে সাধারণ বিষয় বলে জানাচ্ছেন সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটির জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের অধ্যাপক ও চিকিৎসক ড. অ্যাঞ্জেলা স্যানফোর্ড। একসঙ্গে একাধিক কাজ করা বা 'মাল্টিটাস্কিং'-এ সমস্যা হতে পারে। তবে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলে, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে মানসিক দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষাও করিয়ে নেওয়া যায়।
ঘুমের ব্যাঘাত এই বয়সে অনেক বেশি দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ বছর বয়সের পর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ ঘুম নিয়ে সমস্যায় ভোগেন।
এই বয়সে কী কী করা জরুরি?
ড. স্যানফোর্ড বলছেন, ষাটের দশকে থাকা মানুষদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত। এর পাশাপাশি প্রতিবছর চোখের পরীক্ষা, কোলোরেকটাল ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করানো প্রয়োজন। নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারের স্ক্রিনিং এবং মেনোপজ পরবর্তী হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
জেনেটিক গঠন, জীবনযাপন এবং পরিবেশ—এই তিনটি বিষয়ই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন শ্র্যাক। নিয়মিত চিকিৎসক দেখানো এবং সময়মতো প্রিভেন্টিভ কেয়ার নেওয়া দীর্ঘজীবনের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া শরীরচর্চা এবং চলাফেরা সচল রাখা যেমন মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, তেমনি সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখাও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
৭০-এর দশকে সুস্থ থাকার উপায়
আজকের ৭০ বছর বয়সীরা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। "যেসব জীবনপরিবর্তন আগের প্রজন্মের মানুষেরা ষাটের কোটায় পৌঁছে অনুভব করতেন, সেগুলো এখন অনেকের ক্ষেত্রেই ৭০ বছর বয়সে ঘটছে," বলেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বোস্টনের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর জেফরি স্টোকস, যিনি বয়সজনিত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন। আজকের সত্তরোর্ধ্বরা শুধু বেশি দিন বেঁচে থাকছেন না, বরং দাদি-নানি হওয়ার পাশাপাশি আগের তুলনায় দেরিতে অবসর নিচ্ছেন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলাফেরার ক্ষমতা কমে যাওয়া বা ভারসাম্যহীনতা বাড়ার মতো কিছু শারীরিক সমস্যা সাধারণ হয়ে পড়ে, জানাচ্ছেন ওয়েল করনেল মেডিসিনের জেরিয়াট্রিকস ও প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগের প্রধান ড. মার্ক লাচস।
তবে কারও শরীরে এসব পরিবর্তন কতটা প্রভাব ফেলবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে জীবনযাপন কেমন তার ওপর। বয়স বাড়ার নির্দিষ্ট কোনো ছক নেই। তবে ৭০-এর কোটায় পৌঁছে বাতজ্বর, উচ্চ রক্তচাপ, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি সাধারণ অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
তুলনামূলকভাবে, এই দশক অনেকের ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যদিক থেকে বেশ স্থিতিশীল হতে পারে—বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, যারা এর আগে মেনোপজের বড় পরিবর্তন পার করে এসেছেন।
এই বয়সে কী কী করা জরুরি?
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য যেসব পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশই এই বয়সেও প্রযোজ্য। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পরীক্ষাগুলো আরও জটিল হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিভেদে প্রয়োজন ভিন্ন হতে পারে বলে মনে করেন স্ট্যানফোর্ড লংজেভিটি সেন্টারের সহ-পরিচালক ও মেডিসিনের অধ্যাপক ড. ডেবোরাহ কাডো।
মার্ক লাচসের মতে, এই বয়সে হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা এবং চলাচলের সক্ষমতা নির্ধারণে কিছু স্ক্রিনিং (যেমন পড়ার ঝুঁকি আছে কিনা তা দেখা) গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
মুভমেন্ট বা চলাফেরা সবচেয়ে জরুরি, বলেন ড. লাচস। হালকা পর্যায়ের যেকোনো কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম উপকারে আসবে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ হোক তা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিংবা নৈমিত্তিক—মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক।
এই বয়সে সন্তান-নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলেও, নতুন সম্পর্ক তৈরির প্রবণতা কমে আসে। কিন্তু জেফরি স্টোকস বলছেন, এই বয়সে নতুন সংযোগ গড়ে তোলা একাকীত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা কাটাতে সাহায্য করতে পারে।
সপ্তাহে নিয়মিতভাবে পর্যাপ্ত ঘুম (প্রতি রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা) এবং সবজিভিত্তিক খাবার খাওয়া, যেখানে মাংস কম থাকে, এগুলিও সুস্থভাবে দীর্ঘজীবন লাভের জন্য সহায়ক।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা
