যাত্রীবাহী বিমানের চেয়েও উঁচুতে ওড়ে যেসব পাখি!

বেশিরভাগ পাখিই খুব বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না। এমু বা ক্যাসোয়ারির মতো পাখিগুলো তো একেবারেই না। যদিও এদের ডানা আছে, কিন্তু সেগুলো আসলে কাজে লাগে না, শুধু পূর্বপুরুষদের উড়তে পারার চিহ্ন হিসেবেই রয়ে গেছে। নিউজিল্যান্ডের বিলুপ্ত মোয়া পাখির তো আবার ডানাই ছিল না।
তবে কিছু পাখি আছে যারা উড়তে পারে এবং অনেক উঁচু আকাশেও ভেসে থাকতে পারে। শুনতে বেশ সহজ লাগলেও, আকাশে এতটা উঁচুতে ওড়া মোটেও সহজ কাজ নয়।
এ ধরনের পাখিদের শরীরকে হতে হয় খুবই দক্ষ—কম শক্তিতে বেশি দূর ওড়া, নিখুঁতভাবে ডানা মেলা আর বাতাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়।
জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, উঁচুতে ওড়ার ক্ষমতা থাকা পাখিদের শরীরে কিছু বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন—তাদের ফুসফুস বড়, শ্বাস নেওয়ার পদ্ধতি আরও কার্যকর, আর রক্তে অক্সিজেন ধরে রাখার ক্ষমতাও বেশি।
গবেষকদের মতে, এসব শারীরিক পরিবর্তনের ফলে পাখিরা কম অক্সিজেনযুক্ত উচ্চতায়ও সহজে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে, সারা শরীরে তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারে এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে।
উঁচুতে ওড়া পাখিদের ডানাও সাধারণত বড় হয়, যা তাদের তুলনামূলকভাবে কম শক্তি খরচ করে দীর্ঘ সময় আকাশে ভেসে থাকতে সাহায্য করে। বড় ডানার কারণে তারা বাতাসের স্রোত ব্যবহার করে সহজেই উঁচুতে উঠতে পারে।
গবেষণায় এমন কিছু পাখির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ২০ হাজার ফুট বা তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম।
রুপেলস গ্রিফন (৩৭,০০০ ফুটের বেশি)
রুপেলস গ্রিফন—যাকে পাখিদের জগতে 'চাক ইয়েগার'ও বলা যেতে পারে—মানব ইতিহাসে শব্দের গতি অতিক্রমকারী প্রথম বৈমানিক।
আফ্রিকার এই শকুনটিকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়তে দেখা গেছে। একবার এই পাখি পশ্চিম আফ্রিকার আকাশে ৩৭,০০০ ফুট উঁচুতে একটি যাত্রীবাহী বিমানের সঙ্গে ধাক্কা খায়—যা অনেক বাণিজ্যিক বিমানের স্বাভাবিক ওড়ার উচ্চতার চেয়েও বেশি।
এই শকুনের শরীরের রক্তে এমন হিমোগ্লোবিন আছে, যা বেশিরভাগ পাখির তুলনায় বেশ ভালোভাবে অক্সিজেন ধরতে পারে। ফলে কম অক্সিজেনযুক্ত উচ্চ আকাশেও এটি অনায়াসে টিকে থাকতে পারে।
রুপেলস গ্রিফন বাতাসের উষ্ণ স্রোত ব্যবহার করে শক্তি না খরচ করেই অনেক উঁচুতে ভেসে থাকতে পারে। মৃত প্রাণীর খোঁজে এরা দিনে বহু কিলোমিটার উড়ে বেড়ায়, বড় বড় এলাকা পাড়ি দেয়, আর তাদের শক্তিশালী ও দীর্ঘ ডানা তাদের উড়তে সহায়তা করে।

বার-হেডেড গুজ (২৭,০০০ ফুটের বেশি)
এই পাখিটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এর কষ্টসাধ্য অভিবাসনের জন্য। প্রতিবছর এটি এমনকি মাউন্ট এভারেস্টের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। মধ্য এশিয়া থেকে উপমহাদেশের দিকে যাওয়ার পথে বার-হেডেড গুজকে ২৭,০০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় উড়তে দেখা গেছে।
এত উঁচুতে বাতাসে অক্সিজেন খুব কম থাকে। সেই পরিবেশে টিকে থাকতে বার-হেডেড গুজের শরীরে রয়েছে বড় ফুসফুস, আর এর পেশিগুলো অক্সিজেন খুব দক্ষভাবে ব্যবহার করতে পারে।
এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা শুধু বাতাসে ভেসে না থেকে টানা ডানা ঝাপটাতে পারে, এমনকি যখন বাতাসে অক্সিজেন প্রায় নেই বললেই চলে—তখনও তারা ওড়ার শক্তি ধরে রাখতে পারে।
অ্যালপাইন চগ (২৫,০০০ ফুটের বেশি)
অ্যালপাইন চগ কাক গোত্রের একটি পাখি, যা ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ার পর্বত এলাকায় বাস করে। বার-হেডেড গুজের মতো দূরত্বে অভিবাসন না করলেও, তারা নিয়মিত খুব উঁচু পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় এবং বাসা বাঁধে।
এই পাখিগুলো ২৫,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতায় উড়তে পারে। তাদের শক্তিশালী বাঁকা ডানা এবং আকর্ষণীয় উড়ানের ধরণের কারণে পাহাড়ি চড়াই-উৎরাইগুলোও তারা সহজে পাড়ি দিতে পারে। তারা পাহাড় থেকে ওঠা বাতাসের স্রোত ব্যবহার করে কম শক্তি খরচ করে উঁচুতে উঠে অনেকক্ষণ ভেসে থাকতে পারে।

হুপার সোয়ান (২৫,০০০ ফুটের বেশি)
হুপার সোয়ান তাদের ট্রাম্পেটের মতো জোরালো কণ্ঠস্বরের জন্য পরিচিত। এরা দূরদূরান্ত থেকে উড়ে বেড়ানো পাখি। ইউরোপ থেকে এশিয়ায় যাত্রার সময় পাইলটরা অনেকবার এই সোয়ানগুলোকে ২৫ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতায় উড়তে দেখেছে।
বিশাল দেহ হলেও, তাদের মজবুত ডানার কারণে তারা দীর্ঘ সময় আকাশে থাকতে পারে। এরা সাধারণত ভি-আকৃতির দলে উড়ে, যা তাদের শক্তি সাশ্রয় করে এবং আরও সহজে উড়তে সাহায্য করে।

স্টেপ ইগল (২৪,০০০ ফুটের বেশি)
স্টেপ ইগল হলো একধরণের শিকারি পাখি, যাদের সাধারণত মধ্য এশিয়ায় দেখা যায়। এরা উষ্ণ বাতাসের স্রোত ধরে বেশ দক্ষভাবেই অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারে।
তাদের বড় ডানা আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিকার ধরতে এবং মৃত প্রাণীর সন্ধান দিতে সাহায্য করে। দীর্ঘ অভিবাসনের সময় এরা পর্বত অঞ্চল পাড়ি দেয়, যেখানে উচ্চতা বজায় রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ল্যামারগিয়ার (২৪,০০০ ফুটের বেশি)
ল্যামারগিয়ার বা দাড়িওয়ালা শকুনটি ইউরোপ থেকে হিমালয় পর্যন্ত পর্বত অঞ্চলে বাস করে। এটি প্রায় ২৪,০০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে পারে।
অন্যান্য শকুন থেকে আলাদা, ল্যামারগিয়ার মূলত হাড়ের মজ্জা খায়। বড় হাড়গুলি অনেক উঁচু থেকে পাথরে ফেলে দেয়, যাতে তা ভেঙে যায় এবং মজ্জা খাওয়া সহজ হয়। এদের দীর্ঘ, সরু ডানা এবং হালকা দেহ তাদের বাতাসে নিখুঁতভাবে উড়ে বেড়াতে করতে সাহায্য করে।
ডেমোইজেল ক্রেন (২৪,০০০ ফুটের বেশি)
ডেমোইজেল ক্রেন পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অভিবাসী পাখি। প্রতিবছর তারা হিমালয় পার হয়ে ভারতে শীতকালীন আবাসে যায়।
২৪,০০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়ার সময় তারা তীব্র ঠাণ্ডা, ঝড়ো বাতাস এবং কম অক্সিজেনের সঙ্গে লড়াই করে। এই পাখিগুলো ধৈর্যশীল এবং পরিবারের প্রতি দৃঢ় বন্ধনের জন্য পরিচিত। সাধারণত তারা দলবদ্ধভাবে থাকে , যেখানে অভিজ্ঞ পাখিরা তরুণ পাখিদের নেতৃত্ব দেয়।