দ্রুজদের রক্ষায় সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলা; সংঘাত নিরসনে ‘নির্দিষ্ট পদক্ষেপ’ নেওয়ার দাবি যুক্তরাষ্ট্রের

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি বাহিনীর ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এদিকে সুয়েইদা প্রদেশে চলমান গোষ্ঠীগত সহিংসতা চতুর্থ দিনেও থামেনি। খবর বিবিসি'র।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, 'আমাদের দ্রুজ ভাইদের রক্ষা করতে এবং শাসকগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী চক্রকে ধ্বংস করতে আমাদের বাহিনী কাজ করছে।'
অন্যদিকে, সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলাকে 'বিশ্বাসঘাতক আগ্রাসন' বলে মন্তব্য করেছে।
রোববার থেকে সুয়েইদায় দ্রুজ মিলিশিয়া ও বেদুইন গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে এখন পর্যন্ত ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলের সহিংসতা নিয়ে তিনি 'চরমভাবে উদ্বিগ্ন'। তবে তার ধারণা, এই সহিংসতা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
বুধবার সন্ধ্যায় এক্স-এ দেওয়া বার্তায় তিনি লেখেন, 'আমরা কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপে একমত হয়েছি, যা আজ রাতেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে।'
সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও আরবপক্ষের প্রচেষ্টাকে 'স্বাগত' জানায় তারা। তবে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েল এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
সিরিয়ার বার্তা সংস্থা সানা জানিয়েছে, সিরীয় সেনারা সুয়েইদা শহর থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। 'বেআইনি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শেষ হওয়ার' পর স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সরকারের এক চুক্তির আওতায় সেনারা শহরটি ছাড়ছে।

সোমবার সুয়েইদায় সিরীয় সেনা ও তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে হামলা চালায় ইসরায়েল। ডিসেম্বর মাসে সুন্নি বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সরিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম শহরটিতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল।
দ্রুজসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারারের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, যদিও তিনি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত আট মাসে একাধিকবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হওয়ায় তাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। মে মাসে দামেস্ক ও সুয়েইদায় দ্রুজ, নিরাপত্তা বাহিনী ও ইসলামপন্থি যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষে বহু মানুষ নিহত হয়।
এরপর সরকার সুয়েইদায় দ্রুজ মিলিশিয়াদের মধ্য থেকে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
নেতানিয়াহু বলেন, সিরিয়ায় দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করা তার অঙ্গীকার, কারণ তাদের সঙ্গে ইসরায়েল ও গোলান মালভূমিতে বসবাসরত দ্রুজদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এক্স-এ লেখেন, 'দামেস্কের জন্য সতর্কবার্তা শেষ হয়েছে। সুয়েইদায় যেসব বাহিনী দ্রুজদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের পুরোপুরি হটানো পর্যন্ত অভিযান চলবে।'
পরে আরেকটি পোস্টে তিনি লেখেন, 'কঠিন আঘাত দেওয়া শুরু হয়েছে।' সেখানে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় দামেস্কের উমাইয়া স্কয়ারে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এক টিভি উপস্থাপক লাইভ সম্প্রচারের সময় টেবিলের নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তারা দামেস্কের প্রেসিডেনশিয়াল প্রাসাদের এলাকায় একটি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এছাড়া সুয়েইদাগামী ভারী অস্ত্রবোঝাই সাঁজোয়া যান এবং দক্ষিণ সিরিয়ায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদামেও হামলা চালানো হয়েছে।
সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় সরকারি ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে এবং এতে 'অনেক নিরীহ মানুষ' নিহত হয়েছে।
তারা আরও জানায়, 'এই স্পষ্ট আগ্রাসন ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা বাড়াতে, বিশৃঙ্খলা ছড়াতে এবং সিরিয়ার স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতেই ইসরায়েলি নীতির অংশ। এটি জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন।'

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানিয়েছে, সুয়েইদায় দ্রুত মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে।
তারা জানায়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ চলছে। এক ট্যাংক হামলা চালায় ন্যাশনাল হসপিটালে, যেখানে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। এতে হাসপাতালজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
পরে সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, 'বেআইনি গোষ্ঠী' পিছু হটার পর সরকারি বাহিনী হাসপাতালে প্রবেশ করে 'ডজনখানেক মরদেহ' উদ্ধার করেছে। খবরটি নিশ্চিত করেছে সানা।
হোসাম নামে এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেন, তিনি সুয়েইদার কেন্দ্রে ছিলেন এবং দেখেছেন বেসামরিক লোকজন আর্টিলারি ও স্নাইপারের গুলিতে নিহত হচ্ছেন। তিনি বলেন, 'আজ আমার এক প্রতিবেশীকে রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমরা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি।'
এসওএইচআরের তথ্য অনুযায়ী, রোববার থেকে এখন পর্যন্ত সুয়েইদায় ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।
এদের মধ্যে ৬৯ জন দ্রুজ যোদ্ধা, ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক (যার মধ্যে ২৭ জনকে স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে), ১৬৫ জন সরকারি বাহিনীর সদস্য এবং ১৮ জন বেদুইন যোদ্ধা। এছাড়া ইসরায়েলি হামলায় সরকারি বাহিনীর আরও ১০ জন নিহত হয়েছেন।
বিবিসি এই হতাহতের সংখ্যা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
সুয়েইদায় সংঘর্ষ শুরু হয় গত শুক্রবার, যখন দামেস্ক মহাসড়ক থেকে এক দ্রুজ ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা হয়।
রোববার সশস্ত্র দ্রুজ যোদ্ধারা শহরের একটি বেদুইন অধ্যুষিত এলাকা ঘিরে ফেলে এবং পরে দখল করে নেয়। দ্রুতই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে সুয়েইদার অন্য এলাকাগুলোতেও। অভিযোগ রয়েছে, বেদুইনরা আশপাশের দ্রুজ শহর ও গ্রামে হামলা চালিয়েছে।
পরে সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবে। তারা জানায়, 'সম্পর্কিত সরকারি সংস্থাগুলোর অনুপস্থিতির কারণে' পরিস্থিতি ভয়াবহভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে।
এ বছরের শুরুতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সুয়েইদাসহ দক্ষিণাঞ্চলের আরও দুই প্রদেশকে নিরস্ত্রীকরণের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট শারার নেতৃত্বাধীন সুন্নি ইসলামপন্থি দল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ইসরায়েলের জন্য হুমকি। এইচটিএস একসময় আল-কায়েদার সহযোগী ছিল। জাতিসংঘ ও যুক্তরাজ্য এখনো একে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র করে না।
আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েল সিরিয়ায় শত শত বিমান হামলা চালিয়ে সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। তারা জাতিসংঘ-পর্যবেক্ষিত গোলান মালভূমি ও সিরিয়ার মধ্যে নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল, আশপাশের এলাকা এবং হারমোন পাহাড়ের চূড়ায় সৈন্য মোতায়েন করেছে।