তারখান: প্রাচীন মিশরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো পোশাক

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, এক মিশরীয় তাঁতি তৈরি করেছিলেন একটি সাধারণ লিনেনের পোশাক। তখন হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি, এই পোশাকটি ঠিক কতকাল টিকে থাকবে।
'তারখান ড্রেস' নামে পরিচিত এই পোশাকটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৮২ থেকে ৩১০২ সালের মধ্যে। এটিই বর্তমানে আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রাচীনতম জটিলভাবে বোনা পোশাক—অর্থাৎ এমন একটি জামা যা কেটে ও সেলাই করে তৈরি, শাড়ি বা চাদরের মতো জড়িয়ে পরার ধাঁচে নয়।
প্রাচীনকালে মানুষ প্রধানত নিজেদের উষ্ণ রাখা ও শরীরকে রক্ষা করার জন্য গায়ে পেঁচিয়ে পরার পোশাক ব্যবহার করত, যা খুব সহজেই পচে যাওয়ায় তেমন কোনো নমুনা পাওয়া কঠিন। তবে 'তারখান ড্রেস' এই ধারার বাইরে, এটি সূক্ষ্মভাবে বোনা, কাটা ও সেলাই করা একটি প্রাচীন পোশাক, যার মাধ্যমে যা প্রাচীন মিশরীয় কারিগরি দক্ষতা, ফ্যাশন ও নান্দনিক রুচির একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
তারখান শহরের কাছাকাছি এক পুরনো সমাধিক্ষেত্রে ১৯১৩ সালে এই পোশাকটি আবিষ্কার করেন খ্যাতিমান ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার ফ্লিন্ডার্স পেট্রি। কায়রো থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এইসমাধিক্ষেত্রে পেট্রি খননকাজের সময় এক 'মাস্তাবা'—এক ধরনের চ্যাপ্টা ছাদবিশিষ্ট আয়তাকার সমাধি—থেকে পোশাকটি খুঁজে পান।

সেই সমাধিক্ষেত্রে তিনি প্রায় দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন সমাধির সন্ধান পান, যেগুলোর বেশিরভাগই প্রোটোডাইনেস্টিক ও প্রাথমিক রাজবংশীয় যুগের, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের কাছাকাছি সময়ের, যখন মিশরে প্রথমবারের মতো রাজারা ঐক্যবদ্ধ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মাস্তাবার ভেতরে পেট্রি যে একটি বড় স্তূপের মতো লিনেন কাপড় আবিষ্কার করেন, তা সম্ভবত আগের কোনও কবর লুটেরারা গুরুত্ব না দিয়ে এক পাশে ফেলে রেখেছিল। পরে সেই কাপড় পেট্রি যুক্তরাজ্যে নিয়ে গেলেও 'তারখান ড্রেস' পোশাকটি দীর্ঘদিন ধুলোমাখা ও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে ছিল একপাশে।
প্রায় ছয় দশক পর, ১৯৭৭ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের সংরক্ষকরা পোশাকটি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, তাদের সামনে আসলে কী পড়ে আছে।
তারখান ড্রেস বর্তমানে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের 'পেট্রি মিউজিয়াম অব ইজিপশিয়ান আর্কিওলজি'-তে সংরক্ষিত আছে।
জাদুঘরের তথ্যমতে, এটি তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাক্স (লিনাম ইউসিটাটিসিমাম) গাছ থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে হাতে বোনা লিনেন কাপড় দিয়ে। গলার নকশা ভি-আকৃতির। পুরো জামায় রয়েছে সরু ভাঁজ, যাকে বলা হয় 'নাইফ-প্লিট'।
পোশাকটির নিচের অংশটি সংরক্ষিত না থাকায় এটি কী শার্ট, টিউনিক না জামা—তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি তৈরি করা হয়েছিল কোনো তরুণী ও হালকা-পাতলা গড়নের নারীর জন্য।
২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ইউসিএলের প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক অ্যালিস স্টিভেনসন লেখেন, ''প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে কাপড়ের মতো সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়া বস্তু টিকে থাকা বিরল ঘটনা। আর সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ কোনো পোশাকের টিকে থাকা তো আরও দুর্লভ।''
সেই বছর প্রকাশিত এক গবেষণায় স্টিভেনসন ও নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসোটোপ বিশেষজ্ঞ মাইকেল ডি কার্বন পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেন—'তারখান ড্রেস' তৈরি হয়েছিল ঠিক মিশরের প্রথম রাজবংশের সূচনালগ্নে।
গবেষকদের ধারণা, জামাটি সম্ভবত সে সময়ের ফ্যাশনের অংশ ছিল। কারণ সমসাময়িক অনেক সমাধি শিল্পে মৃতদের শরীরে এমন পোশাকের চিত্র দেখা যায়। তবে এটি কেবল দাফনের জন্য তৈরি হয়নি। জামাটিতে ব্যবহারের স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয়, জীবদ্দশায় কোনো উচ্চবিত্ত নারী এটি পরতেন।
স্টিভেনসন ও রিচার্ডস জানান, 'তারখান ড্রেস' হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন কাটা-ছেঁড়া ও সেলাই করা পোশাকের উদাহরণ। এটি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার শুরুতেই বস্ত্রশিল্প কেমন ছিল তা বোঝাতে গবেষকদের সহায়তা করছে।