এই গ্রীষ্মে বাড়তে চলেছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি; কেন?

আপনি যদি তাদের মধ্যে একজন হন যারা দিনের প্রতিটি সেকেন্ড গুনে কাজে লাগাতে চান, তাহলে একটা খবর আছে আপনার জন্য। এই গ্রীষ্মে আপনি প্রতিদিনের ৮৬,৪০০ সেকেন্ড পুরোপুরি পাবেন না।
৯ জুলাই, ২২ জুলাই আর ৫ আগস্ট এই তিন দিন পৃথিবী একটু বেশিই দ্রুত ঘুরবে। ফলে প্রতিদিনের সময় থেকে কমে যাবে ১.৩ থেকে ১.৫ মিলিসেকেন্ড।
চোখের পলক ফেলতে প্রায় ১০০ মিলিসেকেন্ড সময় লাগে, তাই এই এক মিলিসেকেন্ড খুব বেশি হয়তো নয়। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতিবিধি এতটাই নিখুঁতভাবে ট্র্যাক করা হয় যে, তাতে এই কয়েক মিলিসেকেন্ড-ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল আর্থ রোটেশন অ্যান্ড রেফারেন্স সিস্টেমস সার্ভিস হ্যাঁ, এমন এক প্রতিষ্ঠানের আসলেই অস্তিত্ব আছে। তারা প্রায় দেড় বছর পরপর পৃথিবীর সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ক্যালেন্ডারে যোগ করে 'লিপ সেকেন্ড'। তাই পৃথিবীর হঠাৎ গতি বাড়া মানে শুধু আশ্চর্য হওয়ার বিষয় নয় এটা বিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও।
ইতিহাসের সবচেয়ে ছোট দিন
বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৪৫০টি অ্যাটমিক ঘড়ি কাজ করছে, যেগুলোর সময়ের নির্ভুলতা এতটাই বেশি যে তারা ১০ কোটি বছরে মাত্র এক সেকেন্ড এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ঘড়িগুলো কেবল সময়ের হিসেব রাখার জন্য কার্যকরী নয়; আবহাওয়ার স্যাটেলাইট, জিপিএস, টেলিকমিউনিকেশন, এমনকি পরমাণু অস্ত্রসহ যুদ্ধাস্ত্রগুলোর জন্যও নিখুঁত সময় জেনে রাখা জরুরি।
তাই যখন জ্যোতির্বিদ এবং এই ঘড়িগুলোর পরিচালকরা লক্ষ্য করেন যে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে অ্যাটমিক সময় মিলছে না, তখন সবাই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখে।
'ডেট অ্যান্ড টাইম'-এর মতে, অ্যাটমিক ঘড়ি চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ছোট দিনের রেকর্ড হয়েছিল গত বছর, ৫ জুলাই সেদিন ২৪ ঘণ্টার তুলনায় ১.৬৬ মিলিসেকেন্ড কম সময় লেগেছিল পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে।
তারও তিন বছর আগে, ২০২২ সালের ৩০ জুন, দিনটা ১.৫৯ মিলিসেকেন্ড কম ছিল। কিন্তু এই গ্রীষ্মে, সামনে আরও তিনটি ছোট দিনের পূর্বাভাস মিলেছে যা এই ঘটনা আরও বিরল করে তুলেছে
পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি হঠাৎ বাড়ে কেন?
পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি এইভাবে পরিবর্তিত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে এবার ঠিক কোন কারণটি দায়ী, তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ চাঁদের অবস্থান। চাঁদ সবসময় পৃথিবীর চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে যার মানে, কখনো সে কাছে আসে , আবার কখনো অনেক দূরে চলে যায় । সবচেয়ে কাছে এলে চাঁদের দূরত্ব হয় প্রায় ২,২৪,০০০ মাইল, আর সবচেয়ে দূরে গেলে হয় ২,৫১,৬৫৫ মাইল।
এই গ্রীষ্মে পৃথিবীর যে তিনটি দিন অপেক্ষাকৃত কম সময়ের হবে, সেসব দিনেই চাঁদ থাকবে এর দূরের অবস্থানে । আর এখানেই মজার ব্যাপার কারণ সাধারণত চাঁদ দূরে গেলে পৃথিবীর গতি কমে যাওয়ার কথা, বাড়ে না।
তবে শুধু দূরত্ব নয়, চাঁদের কক্ষপথটি খানিকটা বাঁকা বা 'বাঁকা কোণে ঝুঁকে' থাকে পৃথিবীর বিষুবরেখার তুলনায়। এই কোণটা ১৮° থেকে ২৮° এর মধ্যে ওঠানামা করে। কোণ যত বেশি হয়, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি তত বেশি বাড়াতে পারে। এবার তিনটি ছোট দিনের সময় চাঁদের এই কোণ প্রায় ২৮° থাকবে যা গতি বাড়ার এক সম্ভাব্য কারণ।
চাঁদের বাইরেও আরও কিছু ঘটনা পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি কম বা বেশি করতে পারে। যেমন ভূমিকম্প। বড় ধরনের ভূমিকম্পে পৃথিবীর ভেতরের ভরবন্টন বদলে যায়। ২০০৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এক ভূমিকম্পে পৃথিবীর মেরু অঞ্চল প্রায় এক ইঞ্চি পূর্বদিকে সরে গিয়েছিল, যার ফলে এক দিনের দৈর্ঘ্য কমে যায় ২.৬৮ মাইক্রোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডের এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ)। তবে সম্প্রতি কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি, তাই এবারকার গতি বাড়ার কারণ হিসেবে ভূমিকম্প বাদই যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন কি পৃথিবীর গতি বদলায়?
হ্যাঁ, জলবায়ু পরিবর্তনেরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। গত বছর নাসার অর্থায়নে পরিচালিত দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে বরফ গলার কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণনের অক্ষ বা ঘূর্ণনের কেন্দ্রবিন্দু প্রায় ৩০ ফুট সরে গেছে। এতে করে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি বদলেছে। কিন্তু এই বদল গতি বাড়ায় না, বরং কমায়। হিসাব বলছে, প্রতি শতকে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমে যাচ্ছে প্রায় ১.৩৩ মিলিসেকেন্ড করে। বর্তমান হারে উষ্ণতা বাড়তে থাকলে, এই শতকের শেষে এক দিনের দৈর্ঘ্য আরও ২.৬২ মিলিসেকেন্ড বেড়ে যেতে পারে।
তবে এটুকুতে থেমে নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ও স্ফীত হওয়া,সবকিছুই পৃথিবীর আকৃতি ও পরিধি সামান্য হলেও বাড়াতে পারে। এমনকি গ্রীষ্মকালে গাছে পাতা গজানোও একটা ভূমিকা রাখতে পারে! ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুলের ভূভৌতিকবিদ রিচার্ড হোম বলেন, "উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মে গাছে যখন পাতা আসে, তখন মাটির ওপরের দিকে ভর সরে আসে,যা পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ থেকে কিছুটা দূরে চলে যায়।"
তবে এসব ঘটনাও পৃথিবীর গতি বাড়ায় না, বরং ধীর করে দেয়।
সবকিছু বিবেচনায় বিজ্ঞানীরা আবার ফিরে যান চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দিকেই। সেটাই সম্ভবত এখনকার এই গতি বৃদ্ধির মূল কারণ। আর এটাই স্বস্তির জায়গা। কারণ পৃথিবী আর চাঁদ তো প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর ধরে একসাথে ঘুরছে, এখনো সেই ছন্দে কোনো বিশৃঙ্খলা আসেনি। ধরে নেওয়া যায়, আরও কয়েক বিলিয়ন বছর তারা এই ছন্দেই ঘুরে যাবে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা