প্রজাপতিবিহীন পৃথিবী: যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রজাতি

স্পেনে এক মাস পর বসন্ত আসবে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ব্রিটিশ পতঙ্গবিদ রব উইলসন মাদ্রিদের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রজাপতি খুঁজতে বের হন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি এই কাজ করছেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন, লেপিডোপটেরা প্রজাতির প্রজাপতির সংখ্যা ক্রমেই কমছে।
বিরল প্রজাতিগুলো আরও দুর্লভ হয়ে উঠছে। এটি শুধু স্পেনেই নয়, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মাদ্রিদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস (এমএনসিএন)-এর পতঙ্গবিদ উইলসন বলেন, 'সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নির্দিষ্ট একটি জায়গায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালানো। আমি মাদ্রিদের কাছের শহর কোলমেনার ভিয়েখোতে এই কাজ করি। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে এক-দুই কিলোমিটার হাঁটি এবং নির্দিষ্ট পরিসরে দেখা প্রজাপতিগুলো নথিভুক্ত করি।' এই পদ্ধতিকে 'ট্রানসেক্ট' বলা হয়।
এই গবেষণায় যুক্ত এমএনসিএন-এর আরেক পতঙ্গবিদ ক্যানসেলা বলেন, 'বেশিরভাগ প্রজাতিকে উড়ন্ত অবস্থাতেই চেনা যায়। তবে কোনো প্রজাতি শনাক্ত করা কঠিন হলে, আমরা জাল দিয়ে ধরে পরীক্ষা করি এবং পরে ছেড়ে দিই।'
বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা একইভাবে প্রজাপতির সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করছেন। ব্রিটিশ বাস্তুবিদ উইলসন বলেন, প্রজাপতির সংখ্যা কমার প্রবণতা বুঝতে দীর্ঘমেয়াদি তথ্য প্রয়োজন। তবে গত আট বছরে যেসব প্রজাতির সংখ্যা বেশি ছিল, সেগুলো কমে গেছে। বিরল প্রজাতিগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও ২০০০ সাল থেকে একইভাবে পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পর্যবেক্ষণ করা ৩৪২ প্রজাতির মধ্যে ২২ শতাংশের সংখ্যা কমেছে। ১০৭টি প্রজাতির ক্ষেত্রে এই হার ৫০ শতাংশেরও বেশি।
বিশ্বের প্রায় সব জলবায়ু অঞ্চলে প্রজাপতির সংখ্যা কমছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলে এই প্রবণতা বেশি। কারণ, সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও খরার প্রভাব বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রজাতিগুলো বিপন্ন হয়ে পড়ছে। টিকে থাকা প্রজাতির সংখ্যা মাত্র ৩ শতাংশ বেড়েছে। সংখ্যায় বাড়তে থাকা দুই-তৃতীয়াংশ প্রজাতি মূলত মেক্সিকোতে পাওয়া যায়।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী ও গবেষণার প্রধান লেখক কলিন এডওয়ার্ডস বলেন, 'বাড়তে থাকা প্রজাতিগুলো মূলত মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকায় পাওয়া যায়। আমার গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তর গোলার্ধের উষ্ণ জলবায়ুতে প্রজাপতিরা ভালোভাবে টিকে থাকে। ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রজাতিগুলো ক্রমশ উত্তরের দিকে সরে যাচ্ছে।'

যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপে প্রজাপতির সংখ্যা আরও দ্রুত কমছে। ১৯৯২ সাল থেকে বেলজিয়ামে এক-তৃতীয়াংশ প্রজাতি হারিয়ে গেছে। বাকি প্রজাতিগুলোর সংখ্যা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। যুক্তরাজ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে ৮ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে এবং মোট প্রজাপতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।
তবে নেদারল্যান্ডসের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯ শতকের শেষ দিকে যে পরিমাণ প্রজাপতি ছিল, তার মাত্র ১৬ শতাংশ এখন টিকে আছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও একই চিত্র দেখাচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে প্রজাপতিবিহীন এক পৃথিবীর ইঙ্গিত দেয়।
প্রজাপতির সংখ্যা কমার প্রধান কারণ হলো মানুষের কর্মকাণ্ড। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা ও কীটনাশকের ব্যবহার এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রামীণ এলাকা পরিত্যক্ত হওয়ার মতো নতুন চ্যালেঞ্জ এই সংকট আরও বাড়াচ্ছে।
নেদারল্যান্ডসের বাটারফ্লাই কনজারভেশন ইনস্টিটিউট-এর গবেষক ক্রিস্টিনা গনসালেসের সংস্থা ইউরোপীয় কমিশনের জন্য 'মিডো বাটারফ্লাই ইনডিকেটর' নামে একটি সূচক পরিচালনা করে। এটি পতঙ্গের সংখ্যা নির্ণয়ের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের মূল্যায়ন করে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নে লেপিডোপটেরা প্রজাতির সংখ্যা ৩২ শতাংশ এবং পুরো ইউরোপে ৩৬ শতাংশ কমে গেছে।
কাতালোনিয়ার বাটারফ্লাই মনিটরিং স্কিম (বিএমএস)-এর বাস্তুবিদ কনস্ট্যান্টি স্টেফানেস্কু কয়েক দশক ধরে স্পেনের কাতালোনিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন। তিনি বলেন, 'গত ৩০ বছরে প্রজাপতির সংখ্যা ৩০-৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।'
ইউরোপের অন্যান্য বিএমএস প্রকল্পগুলোর মতো কাতালোনিয়াতেও একই পদ্ধতিতে প্রজাপতির সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে সেখানে ১৯৯৪ সাল থেকে নিয়মিত গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। স্টেফানেস্কু বলেন, 'ঘাসভিত্তিক আবাসস্থলে কিছু প্রজাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বনাঞ্চলীয় প্রজাতির মধ্যে কিছুটা বৃদ্ধি দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে প্রজাপতির সংখ্যা ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।'
স্পেনের কান্তাব্রিয়ান পর্বতমালায় গবেষণা কম সময় ধরে চললেও পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। গবেষক আমপারো মোরা বলেন, গ্রামাঞ্চল পরিত্যক্ত হওয়ায় পরিবেশ অতিরিক্ত ঘন হয়ে উঠছে। এই পুনঃবনায়ন প্রকৃতপক্ষে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে।
প্রায় ৯০ শতাংশ প্রজাপতি উন্মুক্ত তৃণভূমিতে বাস করে এবং অন্যান্য পতঙ্গের মতোই এদের ফুলসমৃদ্ধ খোলা স্থান প্রয়োজন হয়। কিন্তু বন্য বা গৃহপালিত তৃণভোজী প্রাণীর অভাবে এসব জায়গা ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাচ্ছে।
মোরার পর্যবেক্ষণ করা কান্তাব্রিয়ান পার্কে আইবেরীয় উপদ্বীপের ৬০ শতাংশ প্রজাপতির আবাসস্থল ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রজাপতির সংখ্যা ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। তবে পূর্ণ চিত্র পেতে আরও পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
স্পেনের দক্ষিণে সিয়েরা নেভাদায় অর্ধেকেরও বেশি আইবেরিয়ান প্রজাপতি প্রজাতির আবাসস্থল রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলার জন্য যথেষ্ট নয়।
প্রজাপতিরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা রাখে না।
অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রিদের গবেষক মিগেল লোপেজ মুঙ্গুইরা বলেন, '২০০৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে কোনো প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও তাদের বিলুপ্তি আসন্ন।' তিনি সতর্ক করেন, কিছু করা না হলে প্রজাপতিদের জন্য এক মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে।