প্রজাপতির ঝাঁক যেভাবে বাঁচিয়ে তুললো কোস্টারিকার আস্ত রেইনফরেস্টকে
কোস্টারিকার এক প্রত্যন্ত কোণ। সেখানে একসময় ছিল শুধুই গরুর চারণভূমি। কিন্তু এখন সেই জায়গাটি সবুজে ঘেরা এক রেইনফরেস্ট বা ঘন বর্ষাবন। এই অসাধ্য সাধন করেছে একটি পরিবার। আর তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল হাজার হাজার প্রজাপতি।
সান হোসে থেকে উত্তরের পথটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। চারদিকে ফার্ন গাছ। কুয়াশায় ঢেকে আছে পথঘাট। গ্রামগুলো ক্রমে ছোট হয়ে আসে। বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। পিচঢালা পথ সরু হতে হতে একসময় হারিয়ে যায় জঙ্গলের পেটে। বাসের দরজা খুলতেই চারপাশের সবুজ আমাকে গ্রাস করে নিল।
আমি কাঠের একটি গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে লেখা 'পিয়েরেলা ইকোলজিক্যাল গার্ডেন'। কোস্টারিকার সারাপিকি শহরের এক কোণে লুকিয়ে আছে এই জায়গাটি। অনেক গাইডবইতেও এর নাম নেই। কিন্তু এখানে এলে যে অভিজ্ঞতা হয়, তা ভোলা কঠিন।
একসময় এটি ছিল শুধুই একটি রুক্ষ মাঠ। এখন পারিবারিক এই লজটিকে ঘিরে আছে নতুন করে গড়ে তোলা এক জঙ্গল। পিয়েরেলা-র মালিক উইলিয়াম কামাচো এবং ক্রিস্টাল বারান্তেস। গত তিন দশক ধরে তারা এখানে স্থানীয় গাছপালা লাগিয়েছেন।
বিশ্বের খুব কম জায়গাতেই প্রজাপতি ব্যবহার করে বন তৈরির এমন নজির আছে। এখানে ডজন ডজন প্রজাতির প্রজাপতি পালন করা হয় এবং ছেড়ে দেওয়া হয়। এরা পরাগায়ন করে, বীজ ছড়ায় এবং বনের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। গাছপালা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেছে পাখি, ব্যাঙ, সরীসৃপ, বানর এবং বনবিড়াল বা ওসেলট।
কোস্টারিকায় অনেক বিলাসবহুল ইকো-লজ আছে। কিন্তু এই জায়গাটি আলাদা। এখানে অতিথিরা পরিবারের সঙ্গেই থাকেন এবং খাওয়াদাওয়া করেন। পর্যটনের মাধ্যমে প্রকৃতিকে কীভাবে সারিয়ে তোলা যায়, এটি তার এক দারুণ উদাহরণ।
'অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রস্তুত?'
গেটের কাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাকে স্বাগত জানানো হলো। লাল আদা ফুল আর সেক্রোপিয়া গাছের ফাঁক দিয়ে সেই শব্দ আসছিল। কয়েক পা হেঁটেই খোলা রান্নাঘর ও খাবার জায়গা। ক্রিস্টাল বারান্তেস হাসিমুখে আমাকে ঘরের তৈরি মিষ্টি খেতে দিলেন।
খাওয়া শেষ হতেই ক্রিস্টালের ভাতিজা জেরাল্ড বারান্তেস একটি টেলিস্কোপ বা স্পটিং স্কোপ নিয়ে এল। তার মুখে চওড়া হাসি।
ঘন সবুজ পাতার নিচে জেরাল্ড ফিসফিস করে বলল, 'এদিকে দেখুন।' আমি ঝুঁকে দেখলাম চওড়া পাতার ওপর বসে আছে লাল চোখের এক গেছো ব্যাঙ। গায়ের রং লেবুর মতো সবুজ, চোখ টকটকে লাল, পায়ে নীল ডোরা আর কমলা রঙের ছোট ছোট আঙুল। মনে হচ্ছে আঙুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। একটু দূরেই একটি টুকান পাখি। হলুদ গলা আর বুকে লাল রঙের দাগ। সে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে আয়েশ করে কলা খাচ্ছে।
জেরাল্ড ট্রাইপড ঠিক করতে করতে বলল, 'এবার স্কোপ দিয়ে দেখুন।' লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখলাম রাজকীয় এক টার্কি ভালচার বা শকুন। নীল আকাশের পটভূমিতে তার ছোট লাল মাথাটি স্পষ্ট দেখাচ্ছে। জেরাল্ড জানাল, এই পাখিরা মানুষের বসতি থেকে অনেক দূরে বনের গহীনে থাকে। গাছের অনেক উঁচুতে একটি স্লথ বা অলস প্রাণী ঘুমাচ্ছে। তার বাদামি লোম গাছের ডালের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে বোঝাই যায় না।
জেরাল্ড একটার পর একটা প্রাণী দেখিয়ে চলল। সে জানাল, চার হেক্টরের এই বনে ২০০টিরও বেশি প্রজাতির পাখি আছে। আছে বানর, ইগুয়ানা, বাদুড়, বনবিড়াল এবং অসংখ্য পোকামাকড়। পথের ধারে কোকো গাছও আছে। পর্যটকরা চাইলে নিজেরা চকলেট বানানোর কর্মশালায় অংশ নিতে পারেন।
বিশ্বাস করা কঠিন যে এই সজীব বনটি একসময় ছিল রোদে পোড়া মাঠ।
মাটির সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জেরাল্ড বলল, '১৯৯৫ সালে পিয়েরেলাতে ঘাস ছাড়া কিছু ছিল না। শুধু গরু আর বেড়া।'
উইলিয়াম কামাচো চেয়েছিলেন হারানো বন ফিরিয়ে আনতে। তিনি প্রজাপতি খুব ভালোবাসতেন। তিনি বুঝলেন, প্রজাপতি দিয়েই এই জমিতে প্রাণ ফেরানো সম্ভব। জমানো টাকা দিয়ে তিনি ২০ বাই ২০ মিটারের ছোট্ট এক টুকরো জমি কিনলেন। প্রজাপতিদের প্রিয় গাছ লাগালেন। গড়ে তুললেন পরিবেশবান্ধব প্রজাপতি খামার। তিনি প্রজাপতির পিউপা বা গুটি বিশ্বের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বিক্রি করতে শুরু করলেন।
গত ৩০ বছর ধরে প্রজাপতি বিক্রির সেই আয় দিয়ে তিনি পাশের জমিগুলো কিনেছেন। ধীরে ধীরে রুক্ষ চারণভূমিকে আজকের এই ঘন বনে রূপান্তর করেছেন।
কামাচো কোস্টারিকার প্রথম প্রজাপতি খামারিদের একজন, যিনি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। আগে যারা বন কেটে ফেলত, সেই কৃষকরা এখন এখানে আসে। তারা শিখতে চায়, কীভাবে পশুপালনের বদলে ইকো-টুরিজম বা পরিবেশ পর্যটন করে আয় করা যায়।
জেরাল্ড আমাকে একটি জাল দিয়ে ঘেরা জায়গায় নিয়ে গেল। এর নাম 'বাটারফ্লাই গার্ডেন' বা প্রজাপতি বাগান। ভেতরে ঢুকতেই রঙের মেলা। শত শত প্রজাপতি আমার চারপাশে উড়ছে। মনে হলো অন্য এক জগতে চলে এসেছি।
কামাচো বললেন, 'আমরা গাছ লাগিয়েছিলাম প্রজাপতির জন্য। বাকি কাজ পাখিরাই করেছে।' তার চারপাশে তখন প্রজাপতিরা উড়ছিল। তিনি বুঝিয়ে বললেন, 'প্রজাপতি পাখিদের আকর্ষণ করে। পাখিরা এসে বীজ ফেলে। আর সেই বীজ থেকেই তৈরি হয় বন।'
কোস্টারিকা এখন বিশ্বের প্রধান জ্যান্ত প্রজাপতি রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ পিউপা বা গুটি তারা বিদেশে পাঠায়।
কামাচো জানালেন, পিয়েরেলায় বনায়নের মূল কারিগর এই প্রজাপতিরাই। তারা যখন খায় এবং ডিম পাড়ে, তখন পরাগায়ন হয়। এতে পোকামাকড় খেকো পাখি আর সরীসৃপরা এখানে চলে আসে। এভাবেই খাদ্যের শৃঙ্খল তৈরি হয়। ফিরে আসে ব্যাঙ, বাদুড়, সাপ এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা।
একটি খোলা ল্যাবে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়াল জেরাল্ড। সে জানাল, ১৯৪০ সালে কোস্টারিকার ৭৫ শতাংশ বন ছিল। ১৯৮৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২১ শতাংশে। তবে সারা দেশে বনায়ন ও ইকো-টুরিজমের কারণে এখন আবার ৬০ শতাংশ বন ফিরে এসেছে। তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে রাখা প্রজাপতির গুটি। জেরাল্ড সাবধানে একটি গুটি তুলে দেখাল। আমি দেখলাম, একটি শুয়োপোকা কীভাবে গুটিতে পরিণত হচ্ছে। চোখের সামনেই ঘটে গেল এক জাদুকরী রূপান্তর।
১৯৯৫ সাল থেকে কামাচো এবং ক্রিস্টাল হাজার হাজার পর্যটক ও ছাত্রছাত্রীদের এই বন ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। পর্যটকদের টাকায় তাদের সংসার চলে, আবার বনায়ন ও শিক্ষার কাজও হয়।
সূর্য ডুবলে আমি খাবার জায়গায় গেলাম। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল 'কাসাডো'। এটি কোস্টারিকার ঐতিহ্যবাহী খাবার—ভাত, বিনস, সালাদ, ভাজা কলা আর মুরগি। সঙ্গে ছিল 'ওলা দে কার্নে' বা গরুর মাংসের স্টু। সব রান্না হয়েছে কাঠের আগুনে। বাতাসে ধোঁয়া আর মশলার দারুণ গন্ধ।
অন্ধকার নামতেই জেরাল্ড হেডল্যাম্প নিয়ে হাজির। 'চলুন রাতের বন দেখি।'
রাতের বেলা বনের রূপ বদলে যায়। দেখার চেয়ে শোনার অনুভূতি তখন প্রবল। ব্যাঙ ডাকছে, পাতার সঙ্গে ডানার ঘষা লাগছে, আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। টর্চের আলোয় দেখলাম পাতা-কাটুনি পিঁপড়ারা মাথায় সবুজ পাতা নিয়ে লাইন ধরে হাঁটছে। দেখলাম স্ট্রবেরি পয়জন ডার্ট ফ্রগ বা বিষাক্ত ব্যাঙ, কুণ্ডলী পাকানো সাপ এবং বাসিলিস্ক।
পথের এক জায়গায় বিশাল এক হেলিকোনিয়া পাতার পাশে থামল জেরাল্ড। বলল, 'নিচ থেকে দেখুন।' আমি নিচু হয়ে উঁকি দিলাম। পাতার নিচে একদল সাদা বাদুড় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। টর্চের আলোয় তাদের সাদা লোম চকচক করছে। আমি জানতামই না যে সাদা বাদুড় হয়! আমি রোমাঞ্চিত হলাম।
লজে ফিরে নিজের ঘর দেখেও মুগ্ধ হলাম। কেবিনের কাঠের ঘরগুলো বনের ভেতর। মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভেতরেই থাকছি।
ভোরবেলা বানরের ডাকে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণ চুপ করে পাখির ডাক আর পোকামাকড়ের গুঞ্জন শুনলাম। খাবার জায়গায় গিয়ে দেখলাম সাদা গলার হামিংবার্ড ফিডার থেকে মধু খাচ্ছে। কাছেই উজ্জ্বল সবুজ রঙের হানি-ক্রিপার পাখি লাফাচ্ছে। আরও অনেক রঙিন পাখি পাকা কলা খাওয়ার জন্য ভিড় করেছে। এমন অনেক পাখি আমি আগে কখনো দেখিনি। সকালের এই ঐকতান শুনতে শুনতে আমি কফিতে চুমুক দিলাম।
নাস্তার টেবিলে জেরাল্ড আমার পাশে একটি গুটি রাখল। বলল, 'এটি এখনই ফুটবে।' কয়েক মিনিটের মধ্যে খোলসটি কেঁপে উঠল এবং ফেটে গেল। একটি ভেজা প্রজাপতি বেরিয়ে এল। তার ডানাগুলো রেশমের মতো নরম।
প্রজাপতি বাগানে ফিরে গিয়ে দেখলাম, সদ্য জন্ম নেওয়া একটি নীল মরফো প্রজাপতি ধীরে ধীরে তার উজ্জ্বল ডানা মেলছে। তারপর সেটি উড়ে গেল গাছের মগডালের দিকে। সবুজের মাঝে হারিয়ে গেল এক ঝলক নীল রং।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই পুরো জগতটি তৈরি হয়েছে মাত্র একটি ভাবনা থেকে। ভাবনাটি হলো—প্রজাপতির জন্য গাছ লাগালে একদিন জঙ্গল ফিরে আসবে। ছোট্ট একটি কাজ, যার ফলাফল বিশাল। একেই হয়তো বলে সত্যিকারের 'বাটারফ্লাই ইফেক্ট' বা প্রজাপতি প্রভাব।
