জলবায়ু সম্মেলনের জন্য রাস্তা বানাতে আমাজনে ১০ হাজার একর বন উজাড় ব্রাজিলের

ব্রাজিলের বেলেম শহরে এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য সংরক্ষিত আমাজন রেইনফরেস্টের ১০ হাজার একর জঙ্গল কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি নতুন চার লেনের হাইওয়ে।
এই হাইওয়ে নির্মাণের উদ্দেশ্য শহরের যানজট কমানো, যাতে জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে।
রাজ্য সরকার এই প্রকল্পকে 'টেকসই' বলে প্রচার করছে। কিন্তু স্থানীয় ও পরিবেশবিদরা পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, এই রাস্তা জলবায়ু সম্মেলনের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক। কারণ সারা বিশ্বের কার্বন শোষণ ও জীববৈচিত্র্যে আমাজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আংশিক নির্মিত এই রাস্তার দুপাশে এখনও মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ঘন অরণ্য, একসময়ের বিস্তীর্ণ জঙ্গলের সাক্ষী হয়ে। জঙ্গল কেটে গাছের গুঁড়ি স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। ১৩ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের এই রাস্তা রেইনফরেস্টের বুক চিরে চলে গেছে বেলেম শহরের দিকে।
বুলডোজার আর ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে সংরক্ষিত অঞ্চলের জলাভূমি বুজে পাকা রাস্তা করা হচ্ছে।
এই রাস্তা থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে থাকেন ক্লডিও ভেরেকেট। আগে এখানকার গাছে জন্মানো আসাই বেরি বিক্রি করেই চলত তার সংসার।
তিনি ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বলেন বলেন, 'সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের সবগুলো ফলের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎসও আর নেই।'

ক্লডিও জানান, রাজ্য সরকার থেকে এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তিনি। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চলছে তার।
কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার উদ্বেগ, এই সড়কের হাত ধরে ভবিষ্যতে আরও বন উজাড় হবে। কারণ এই রাস্তা হওয়ায় ব্যবসায়ীদের জন্য জায়গাটা আরও সহজলভ্য হবে।
'ভয় হচ্ছে, একদিন কেউ এসে বলবে, "এই নাও টাকা, এখানে আমরা একটা গ্যাস স্টেশন বানাবো, বা একটা গুদামঘর তৈরি করব।" তখন আমাদের চলে যেতে হবে।
'আমরা তো এখানেই জন্মেছি, বড় হয়েছি। আমরা যাব কোথায়?'
যারা রাস্তার পাশে বাস করবে, এ থেকে তারা কোনো উপকারই পাবে না।

ক্লডিও বলেন, 'এই হাইওএর পাশে যারা থাকছে, তারা কোনো সুফল পাবে না। এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক চলবে, তাই ওরাই উপকার পাবে। কেউ যদি অসুস্থ হয়, আর বেলেমের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তবু আমরা এই রাস্তা ব্যবহার করতে পারবো না!'
এই রাস্তাটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলবে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এর ফলে বন্যপ্রাণীদের চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে এবং গোটা বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়তে পারে।
বন্যপ্রাণী চিকিৎসক ও গবেষক অধ্যাপক সিলভিয়া সারদিনহা এই মহাসড়কের পাশেই একটি পশু হাসপাতালে কাজ করেন। তিনি ও তার দল বন্যপ্রাণীদের সুস্থ করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করেন। কিন্তু এই রাস্তা তাদের কাজ আরও কঠিন করে তুলবে।
অধ্যাপক সিলভিয়া বলেন, 'একবার বন ধ্বংস হলে, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এসব প্রাণীকে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করার বড় একটা জায়গা হারাব আমরা; সেই এলাকা এসব প্রজাতির প্রাকৃতিক পরিবেশ।
'ভূমিতে চলাচলকারী প্রাণীরা [রাস্তার কারণে] একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে পারবে না। তাদের বিচরণের এলাকা কমে যাবে, প্রজননও বাধাগ্রস্ত হবে।'
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশমন্ত্রী দাবি করেছেন, কপ-৩০ হবে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন—কারণ সম্মেলনটি 'আমাজন নিয়ে নয়, আমাজনের ভেতরেই' অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট বলছেন, এই সম্মেলন বিশ্বকে আমাজনের প্রয়োজনীয়তা এবং ফেডারেল সরকার বনটি রক্ষায় কী কী উদ্যোগ নিয়েছে, তা তুলে ধরবে।
কিন্তু অধ্যাপক সিলভিয়া সারদিনহা বলছেন, এই আলোচনাগুলো হবে 'উচ্চ পর্যায়ে—ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে'। অথচ যারা আমাজনে বাস করে, তাদের কথা 'কেউই শুনছে না'।
পরা রাজ্য সরকার ২০১২ সালেই অ্যাভেনিডা লিবার্দাদে নামের এই মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে তা বারবার বাতিল হয়ে যায়।
কিন্তু এবার কপ-৩০-এর জন্য শহরকে প্রস্তুত করতে অনেকগুলো অবকাঠামো প্রকল্প ফের চালু করা হয়েছে অথবা নতুন করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
পারা রাজ্যের অবকাঠামো সচিব অ্যাডলার সিলভেইরা জানিয়েছেন, এই মহাসড়ক শহরের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের জন্য নেওয়া ৩০ প্রকল্পের একটি। তার মতে, এই সড়কের ফলে 'শহরের মানুষ উপকৃত হবে, এবং কপ৩০ আয়োজনের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি'।
তিনি বলেন, রাস্তার পাশাপাশি থাকবে বন্যপ্রাণীদের জন্য পারাপারের ব্যবস্থা, সাইকেল লেন এবং সৌরবিদ্যুৎচালিত আলোর ব্যবস্থা। এছাড়া নতুন হোটেল তৈরি হচ্ছে এবং বন্দর সংস্কার করা হচ্ছে, যাতে ভাসমান ক্রুজ জাহাজে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করা যায়।

তাছাড়া বেলেম বিমানবন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় সরকার ৮১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। বর্তমানে যেখানে ৭ মিলিয়ন যাত্রী যেতে পারে, সেখানে ১৪ মিলিয়ন যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
পার্ক দা সিদাদে নামক ৫ লাখ বর্গমিটারের নতুন একটি পার্ক নির্মাণাধীন আছে। সেখানে থাকবে সবুজ এলাকা, রেস্টুরেন্ট, স্পোর্টস কমপ্লেক্স ও স্থাপনা।
শহরের ঐতিহ্যবাহী ভের-ও-পেসো বাজারের অনেক ব্যবসায়ী মনে করছেন, এই উন্নয়ন শহরের জন্য ভালো হবে।
চামড়ার জুতা ব্যবসায়ী ডালসি কারদোসো দা সিলভা বলেন, 'শহরটা সার্বিকভাবে উন্নত হচ্ছে, মেরামত করা হচ্ছে, বাইরের অনেক মানুষ আসছে। এর মানে, আমি বেশি বিক্রি করতে পারবো, বেশি আয় করতে পারব।'
তিনি মনে করেন, এর প্রয়োজন ছিল। কারণ 'আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন বেলেম ছিল সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, যত্নে রাখা। কিন্তু এখন শহরটি অবহেলিত, শাসকগোষ্ঠীর কারো কোনো আগ্রহই নেই।'
হোয়াও আলেক্সান্দ্রে ত্রিন্দাদে দা সিলভা বাজারে আমাজনের ভেষজ ওষুধ বিক্রি করেন। তিনি স্বীকার করেন, সব নির্মাণকাজই কিছু সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।