ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাডার বিরুদ্ধে ভারতের ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি চপ্পল নকলের অভিযোগ

শুরুটা হয়েছিল বেশ সাধারণভাবে। মাসের শুরুতে জনপ্রিয় ফ্যাশন শো 'মিলান ফ্যাশন উইক' অনুষ্ঠানে ইতালির নামীদামি ব্র্যান্ড 'প্রাডা' তাদের মডেলদের পায়ে পরিয়েছিল টি-স্ট্র্যাপ স্যান্ডেল।
কিন্তু এর পরেই ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। অনেকের মতে, এই স্যান্ডেল দেখতে অবিকল ভারতের ঐতিহ্যবাহী 'কোলাপুরি চপ্পল'-এর মতো।
হাতে তৈরি এই চামড়ার জুতা বহু বছর ধরেই ভারতের কোটি কোটি মানুষ পায়ে পরেন। এই চপ্পলের বিশেষত্ব হলো এর পাতলা, সমতল সোল।
এই চপ্পলের নাম এসেছে পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের কোলাপুর শহরের নাম থেকে, যেখানে এগুলো তৈরি হয়। কোলাপুরি চপ্পল ভারতীয় ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তাই অবিকল দেখতে প্রাডার এই ডিজাইন ঘিরে শুরু হয়েছে বিতর্ক—কেউ কেউ বলছেন এটি চুরি করা নকশা, আবার কেউ বলছেন, ভারতের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে সেটাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করছে প্রাডা। ভারতের অনেকেই দাবি তুলেছেন, প্রাডাকে অবশ্যই ভারতের এই ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিতে হবে।
বিশ্বে ভারতের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভারতীয়রা এখন আরও সচেতন। তারা চাইছেন, ভারতের সংস্কৃতি, ডিজাইন বা ঐতিহ্য কেউ ব্যবহার করলে, সঠিক কৃতিত্ব যেন ভারতকেই দেওয়া হয়।

যদিও মহারাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার সংস্থাটি প্রাডাকে একটি কড়া প্রতিবাদপত্র পাঠানোর পর অবশেষে ক্ষমা চেয়েছে ইতালির ফ্যাশন হাউস প্রাডা—এমনটাই জানিয়েছে ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই।
অভিযোগটি স্বীকার করে প্রাডা এক বিবৃতিতে জানায়, 'ভারতের মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের নির্দিষ্ট কিছু জেলায় তৈরি ঐতিহ্যবাহী জুতার অনুপ্রেরণায় তৈরি স্যান্ডেলগুলো মিলানে অনুষ্ঠিত মেন'স ২০২৬ স্প্রিং-সামার ফ্যাশন শোতে প্রদর্শিত হয়েছে।' উল্লেখ্য, কর্নাটক মহারাষ্ট্রের পাশের রাজ্য।
প্রাডা আরও জানায়, ভারতের স্থানীয় কারুশিল্পীদের সঙ্গে তারা 'গঠনমূলক আলোচনায়' এগোতে চায় এবং এ বিষয়ে মহারাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ চলছে।
ব্যাপারটি নিয়ে ভারতীয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল লেখিকা কানিকা গেহলৌত মনে করেন, এই বিতর্কে মূল উদ্বেগের বিষয় হলো—যদি শেষ পর্যন্ত প্রাডা এই স্যান্ডেল বাজারে আনে, তবে লাভবান হবে তারা, আর উপেক্ষিতই থেকে যাবে ভারতের কোলাপুরি শিল্প।

তবে তিনি এটিকে 'আইনগত ভিত্তি না থাকা এক রাগের বহিঃপ্রকাশ' হিসেবে দেখছেন। কারণ, প্রাডার আসলেই এই স্যান্ডেল বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
গত সোমবার প্রাডার এক মুখপাত্র জানান, 'পুরো সংগ্রহগুলো এখনো নকশার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কোনো পোশাক বা অনুষঙ্গ এখনও চূড়ান্তভাবে উৎপাদনের সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি, বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছাড়াও হয়নি।'
জুতাটি ঘিরে শুরু হওয়া বিতর্ক মনে করিয়ে দেয় প্রায় এক দশক আগের একটি ঘটনা, যখন ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার পল স্মিথ এমন একটি স্যান্ডেল বাজারে আনেন, যার নকশা অনেকটাই পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী 'পেশাওয়ারি চপ্পল'-এর মতো। তিনি ওই স্যান্ডেলটি বাজারে বিক্রি করেন ৫৯৫ ডলারে। পরে সমালোচনার মুখে কোম্পানি ওয়েবসাইটে স্যান্ডেলটির বিবরণ পরিবর্তন করে জানায়, এটি পেশাওয়ারি চপ্পল থেকে অনুপ্রাণিত।
এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের অনেক দেশ 'ভৌগোলিক নির্দেশক' বা জিআই (Geographical Indication) ট্যাগ ব্যবহার করে। এটি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ পণ্যের পরিচয় তুলে ধরে—যেমন ফ্রান্সের বোর্দো অঞ্চলের বোর্দো ওয়াইন কিংবা ভারতের দার্জিলিং চা। এই ট্যাগ মূলত সেই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও কারুশিল্প রক্ষার জন্য তৈরি, যা অনেক সময় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, বরং একটি পুরো সম্প্রদায়ের মাধ্যমে প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত হয়।
তবে এই স্বীকৃতি পণ্যের অনুকরণ ঠেকানোর কোনও আইনি উপায় নয়, বরং মূল পণ্যের স্বাতন্ত্র্য ও গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি। ২০১৯ সালে ভারত সরকার কোলাপুরি চপ্পলকে এই জিআই ট্যাগের স্বীকৃতি দেয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনজীবী সুবহাং নায়ার জানান, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের ওই আটটি জেলার কারিগরদের কাছ থেকে স্যান্ডেল সংগহ করার শর্ত পূরণ করা হলে জিআই ট্যাগযুক্ত কোলাপুরি চপ্পল যেকোনো মুনাফাযুক্ত মূল্যে বিক্রি করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রাডার আছে। তবে এর পাশাপাশি কারিগরদের অবশ্যই স্বীকৃতি জানাতে হবে।
অন্যদিকে আরেক আইনজীবী প্রিয়ম লিজমারি বলেন, 'প্রাডা কখনও বলেনি এটি কোলাপুরি চপ্পল। তারা শুধুমাত্র বলেছে এটি কোলাপুরি চপ্পল-অনুপ্রাণিত এক ধরণের লেদার জুতা, যা এর সঠিক এবং যথাযথ বিবরণ।'
তবুও, প্রিয়মের মতে, প্রাডা শুরু থেকেই কারিগরদের যথাযথ কৃতিত্ব না দেওয়ায় এখন একটি 'নৈতিক সমস্যা' তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, 'যদি তারা প্রথম থেকেই তাদের অনুপ্রেরণার কথা স্বীকার করত, তাহলে হয়তো এত বড় বিতর্ক হতো না।'

ভারত এখন নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন—তা সে যোগব্যায়ামই হোক, হলুদের ক্ষত সারানোর গুণ, কিংবা রঙিন ভারতীয় কাপড় ও হস্তশিল্প। এর একটি কারণ হলো, এসব পণ্য বিশ্বের অনেক দূরবর্তী স্থানে পৌঁছেছে এবং এখন ব্যাপক পরিচিতি পাচ্ছে।
তবে কখনও কখনও এই সাংস্কৃতিক গর্ব অতিরিক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদের রূপ নিতে পারে। ফ্যাশন ডিজাইনার ওস্কার দে লা রেন্টার সাবেক সহকারী রাঘবেন্দ্র রাঠোর বলেন, 'আমরা এখন খুব স্পর্শকাতর একটা সমাজে পরিণত হয়েছি।'
ভারতীয় সংস্কৃতির অংশগুলো যখন বিদেশের মাটিতে পৌঁছায়, তখন তা নিয়ে বেশ গর্ব অনুভব করেন রাঘবেন্দ্র রাঠোর। তিনি মনে করেন, সাধারণ কোলাপুরি চপ্পল—যার একজোড়ার দাম ভারতে ১,০০০ থেকে ৩,০০০ রুপি (প্রায় ২০ থেকে ৩০ ডলার)—যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি পায়, তখন সেটিকে ক্ষোভের নয়, বরং একটি উদযাপনের বিষয় হিসেবে দেখা উচিত।
তিনি বলেন, 'এই ঘটনায় ঐসব কারিগর সম্প্রদায়ের কোনো ক্ষতি হয়নি।' বরং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবিত বিশ্বে হাতে তৈরি এই চপ্পলের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে বিক্রি বাড়াতেও সহায়ক হতে পারে।
এর প্রমাণ হিসেবে রাঠোর জানান,বিতর্ক শুরুর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শপিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাকে ও তার টিমকে একের পর এক কোলাপুরি চপ্পলের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে।