যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ

হাইলাইটস
- যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে প্রচলিত আইনি ভাষার ঘাটতি রয়েছে
- যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ যেন তৃতীয় দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক বৃদ্ধি অনুসরণ করে
- ঢাকা বলেছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইন বাংলাদেশের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়
- যুক্তরাষ্ট্র আরও চায় যে, যেসব পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে, সেসব পণ্যে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশকে এ সুবিধা দিতে পারবে না
পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তির নির্ধারিত সময়সীমা ঘনিয়ে আসার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তির মূল শর্তাবলী নিয়ে মতপার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট শীর্ষক এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু শর্তারোপ করেছে, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চা ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ। তবে এনিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে ঢাকা।
গত ২৬ জুন ওয়াশিংটনে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এই মতপার্থক্য প্রকাশ্যে আসে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খালিলুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের দেওয়া খসড়া চুক্তির প্রস্তাবের বিপরীতে পাল্টা প্রস্তাব দেন।
সূত্রগুলো জানায়, ইউএসটিআর বাংলাদেশের পাল্টা প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এরপরে চুক্তির আওতায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কোন কোন পণ্যে জিরো ডিউটি সুবিধা চায়, তার একটি ট্যারিফ সিডিউল চেয়েছে ঢাকা। ওই সিডিউল পাওয়ার পর তা বিবেচনা করার পাশাপাশি, বাংলাদেশও তার রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একই ধরণের সুবিধা চাইবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বাংলাদেশকে ট্যারিফ সিডিউল পাঠায়নি বলে জানা গেছে।
চুক্তির শর্ত ও ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজী হননি বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।
গতকাল সন্ধ্যায় টিবিএসকে তিনি বলেন, ''নেগোসিয়েশন চলমান রয়েছে। উই আর ভেরি মাচ অন ট্র্যাক। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কাছে যেসব ট্যারিফ কনসেশন (শুল্ক ছাড়) চাচ্ছে, একই ধরণের সুবিধা আমরাও তাদের কাছে চাইব। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সুবিধা দিলে, আমরাও সুবিধা দেব। আমরা শেষ সময় পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রেখে সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করব।''
আগামী ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি সভা হবে। ওই সভায় খলিলুর রহমানের সঙ্গে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন আহমেদ। সেখানে চুক্তির শর্তের পাশাপাশি এই ট্যারিফ সিডিউল নিয়ে আলোচনা করবে দুই পক্ষ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিভিন্ন দেশের ওপর আরোপিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ
(পারস্পরিক শুল্ক) ৯ জুলাই থেকেই কার্যকর করা হবে। কোন দেশের ওপর কতো শতাংশ বাড়তি কর কার্যকর করা হবে, তা দ্রুতই দেশগুলোকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের মূল আপত্তির কারণ
আলোচনার বিষয়ে অবহিত সূত্র জানায়, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তিতে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ অ্যাগ্রিমেন্টে সে ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয়নি। সে কারণেই গত তিনমাসে কোনো দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করতে পারেনি, এবং বাংলাদেশের প্রতিযোগী কোনও দেশই এপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তিতে এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কোন দেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে—বাংলাদেশকেও ওই দেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে, বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইন বাংলাদেশের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন একটি শর্তারোপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানিতে ছাড় দেবে, একই পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। কর্মকর্তাদের মতে, এটি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির বিরোধী, যেখানে সব বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে সমতাপূর্ণ আচরণের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ''যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা যদি ১০০ টাকার পণ্য ২০০ টাকায় কিনতে পারে, তাহলে আমরা রপ্তানিও করতে পারব। আর রপ্তানি যদি বন্ধও হয়, তবুও মাথা বিক্রি করে কোন চুক্তি করা উচিত হবে না।''
প্রতিযোগী দেশগুলোও এগোতে পারেনি
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ আভাস পাচ্ছে যে, ৯ জুলাইয়ের আগপর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে, রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রতিনিধিদলও চুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে আলোচনা করতে বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছে।
২৭টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার অভিজ্ঞতা থাকলেও—ভারত এখনও রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের আলোচনা চূড়ান্ত করতে পারেনি।
ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ করেছেন ট্রাম্প। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভারত বাংলাদেশের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বাংলাদেশ মূলত তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করে, আর ভারত বেশি রপ্তানি করে টেক্সটাইল পণ্য বা ফেব্রিক।
আরেক প্রতিযোগী ভিয়েতনামেরও এখনো পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষরে কোন অগ্রগতি নেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শর্ত মেনে নেওয়া হ্যানয়ের জন্য আরও কঠিন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ওপর যাতে বাড়তি শুল্ক আরোপ না হয়। ভিয়েতনাম ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রগতি না হওয়ায়—এক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে ঢাকা।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের গড় শুল্ক হার ৩৭ শতাংশ, ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ এবং চীনের জন্য তা আরও বেশি।
তাই ট্রাম্প আরোপিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ হুবুহু কার্যকর করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হবে না বলে মনে করছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা।