হলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দে যেভাবে বদলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের চিত্র

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে প্রবেশের জন্য শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন—এক বছর আগেও ছিল প্রতিদিনের পরিচিত দৃশ্য। সকাল ৮টায় গ্রন্থাগারটি খোলা হলেও, বিসিএসসহ সরকারি চাকরিপ্রত্যাশীরা ফজরের নামাজের পর থেকেই লাইনে দাঁড়াতেন। এমনকি রাত ১২টা থেকেই শুরু হতো ব্যাগ জমা দেওয়ার জন্য আলাদা লাইন। আগে ব্যাগ রেখে না গেলে, আসন পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু, জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেই দৃশ্য বদলেছে। এখন আর কাক ডাকা ভোরে লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ছে না। দিনে যেকোনো সময় গ্রন্থাগারে গেলেই আসন পাওয়া যাচ্ছে।
নিয়মিত শিক্ষার্থীদের হলে অ্যালটমেন্ট বদলে দিয়েছে চিত্র
বিগত ১৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের আবাসিক হলগুলোতে কোন শিক্ষার্থী উঠতে পারবেন, কে পারবেন না, কোন কক্ষে থাকবেন—এসব নির্ধারণ করতেন ছাত্রলীগের নেতারা। সেসময় ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতাদের মাধ্যমে হলে থেকে যেতেন, যার প্রভাব পড়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে গ্রন্থাগার সুবিধায়ও।
তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সিট বণ্টনের ক্ষমতা ফিরছে প্রশাসনের হাতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট ড. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। সিট বরাদ্দ এবং হল পরিচালনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে।'
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রত্ব শেষ এমন শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ফলেই—কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ভিড়ের চিত্র বদলেছে।

গত দু'বছর ধরে সরকারি চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে যাওয়া হয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল আলমের।
নিজ চোখেই এই পরিবর্তনের সাক্ষী রেজাউল বলেন, 'অভ্যুত্থানের আগে ফজরের পরই ব্যাগ রেখে আসতে হতো। এখন দুপুরে এলেও সহজেই আসন পাওয়া যায়।'
রেজাউল মনে করেন, অভ্যুত্থানের আগে যারা অনেকদিন ধরে হলে ছিলেন, তাদের চলে যেতে হওয়ায় এই পরিবর্তন এসেছে।
'আগে মাস্টার্স শেষ করার পরও অনেকে হলে থাকতেন। এখন সেটা আর সম্ভব নয়,' বলেন তিনি।
সোমবার সকাল ৯টার দিকে ঢাবির গ্রন্থাগারে ঘুরে রেজাউলের কথার সত্যতা পাওয়া যায়। বেশকিছু আসন তখনও শূন্য ছিল। অথচ কয়েক মাস আগেও এসময় গ্রন্থাগারে আসন পাওয়া ছিল দুরূহ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পূর্বেও—কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতেন এমন অন্তত আট জন সরকারি চাকরি প্রত্যাশীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের কেউ এখন রাজধানীর লালবাগে থাকছেন, কেউ আজিমপুর, কেউ আবার নিজ জেলায় ফিরে গেছেন।
২০২৩ সালে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন আমানউল্লাহ রিয়াজ। অভ্যুত্থানের পর ৫ মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিলেও—হলের বাইরে খরচ সামলাতে না পেরে নিজ বিভাগ রংপুরে চলে যান তিনি। বর্তমানে রংপুর থেকেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
রিয়াজ বলেন, 'সরকার পরিবর্তনের আগে মনে করিনি এত দ্রুত হল ছাড়তে হবে। মাস্টার্সের পর কেউ আর হলে থাকতে পারছে না। এটা আগে ভাবাই যেত না।'

রিয়াজের মতোই গল্প ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি চাকরি প্রত্যাশী অনেক শিক্ষার্থীর।
প্রায় আড়াই বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ফারজীব সালমান। তখন থেকেই সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। সালমান বলেন, 'আগে মাস্টার্স শেষ হলেও কিছুদিন হলে থাকার অলিখিত নিয়ম ছিল, কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে হলে ছেড়েছি।'
'হলে থাকাকালীন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও রিডিং রুমেই প্রস্তুতি নিতাম। এখন হলে নেই, লাইব্রেরি দূরে তাই আজিমপুর বাসায় বসেই প্রস্তুতি নিচ্ছি,' বলেন তিনি।
গ্রন্থাগারে চাকরির প্রস্তুতি, কতটা যৌক্তিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। গ্রন্থাগার মূলত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পাঠের কেন্দ্র, অথচ দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরি প্রার্থীদের প্রস্তুতির প্রধান স্থান হয়ে উঠেছে। সিংহভাগ শিক্ষার্থী এখনও চাকরির প্রস্তুতি নিতেই গ্রন্থাগারে আসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি কখনো বিসিএস বা চাকরির পরীক্ষার পড়াশোনার কেন্দ্র হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে হলে, নিজের কক্ষে। এছাড়া হলগুলোতে আলাদা করে রিডিং রুম থাকতে পারে।'
তিনি বলেন, এতদিন শিক্ষার্থীরা হলে পড়াশোনার পরিবেশ পায়নি। হলগুলোতে এখনও যে খুব ভালো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তেমনটা হয়তো বলা যাবে না। তবে অন্তত আগের মতো সরকারপক্ষীয় ছাত্রসংগঠনের নিপীড়ন নেই। তবে এই পরিবেশ ভবিষ্যতেও রক্ষা করা সম্ভব হবে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।