'পারফেক্ট' আপেলের খোঁজে ভারতের বিজ্ঞানীরা!

'আমার প্রতিবেশীরা ভেবেছিল, আমি বুঝি পাগল হয়ে গেছি' বলছিলেন ভারতের মহারাষ্ট্রের এক কৃষক, কাকাসাহেব সাওয়ান্ত। বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই কৃষকের আপেল চাষের গল্প।
২০২২ সালে হঠাৎ করেই সাওয়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, নিজের খামারে আপেল গাছ লাগাবেন। একজন কৃষকের এমন উদ্যোগে অবাক হওয়ার কিছু নেই—তবে তিনি যখন থাকেন দক্ষিণ ভারতের এক উপক্রান্তীয় অঞ্চলে, যেখানে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটা নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিকই বটে। কারণ, আপেল তো মূলত ঠান্ডা, পাহাড়ি অঞ্চলের ফল।
তবুও সিদ্ধান্তে অটল থেকে সাওয়ান্ত ১০০টি আপেল গাছের চারা রোপণ করেন। এর মধ্যে ৮০টি গাছ টিকে যায়। বছরখানেকের মধ্যেই প্রতিটি গাছে ফল ধরতে শুরু করে—প্রতিটি গাছ থেকে আসে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কেজির মতো আপেল!
সাওয়ান্ত গর্ব করে বলেন, 'স্থানীয়দের কাছে আমার খামারটি এখন বেশ কৌতূহলের জায়গা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে, মহারাষ্ট্রের এই গরমে কীভাবে আপেল ধরে তা দেখতে।'
তবে এই সাফল্যের মাঝেও আছে বড় এক ধরণের সীমাবদ্ধতা—এই আপেলগুলো এখনও বাজারে বিক্রির মতো যথেষ্ট মিষ্টি নয়।
তবুও আশা হারাননি সাওয়ান্ত। আপেল গাছের চারা বিক্রি করে ইতোমধ্যে কিছুটা লাভ করেছেন, আর ভবিষ্যতের ফসল নিয়ে আছেন আশাবাদী।
'এটা তো কেবল শুরু,' বলেন তিনি। 'গাছগুলো এখনও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আমার ধারণা, আরও চার-পাঁচ বছরের মধ্যে এরা ভালো, মিষ্টি আপেল দেবে।'
তবে গরম অঞ্চলে আপেল চাষের বানিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই এখনো সন্দিহান।
'যেসব এলাকায় স্বাভাবিকভাবে আপেল হয় না, সেখানে ফলের স্বাদও ভালো হয় না, আবার বেশিদিন টেকেও না,' বলেন ড. দিনেশ ঠাকুর, যিনি ড. ওয়াইএস পারমার ইউনিভার্সিটি অফ হর্টিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রির অধীন একটি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সহযোগী পরিচালক।
তার ভাষ্যে, 'এই কম-ঠান্ডা-প্রয়োজনীয় আপেল গাছগুলো শখের বশে রান্নাঘরের বাগানে লাগানো যায়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক কি না, সেটা এখনো প্রমাণিত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।'
ড. ঠাকুর নিজেও কাজ করছেন আপেলের নতুন জাত উদ্ভাবনে। গবেষণার ক্ষেত্র হিমাচল প্রদেশ—ভারতের ঐতিহ্যবাহী আপেল অঞ্চল।
তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন আপেল চাষে নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
'আপেল গাছে ফল ধরার জন্য যে "চিলিং আওয়ার" দরকার, সেটার পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে,' বলেন তিনি। 'একই সঙ্গে অনিয়মিত আবহাওয়াও বড় সমস্যা—যার ফলে কৃষকেরা প্রতি বছর বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।'
এই পরিস্থিতিতে অনেকেই এখন নতুনভাবে ভাবছেন। একসময় যেসব উঁচু এলাকা অতিরিক্ত ঠান্ডার জন্য উপযুক্ত মনে হতো না, সেখানেই এখন গড়ে উঠছে আপেলের নতুন বাগান।
ড. দিনেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রকল্পে পরীক্ষামূলকভাবে ৩০০ জাতের আপেল নিয়ে কাজ চলছে। লক্ষ্য—জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কোন জাত কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল তা বোঝা।
'আমরা এখন এমন জাত নিয়ে কাজ করছি যেগুলো প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে,' বলেন ড. ঠাকুর। 'জলবায়ু-সহনশীল আপেলের জিনগত বৈচিত্র্য খুঁজছি, যাতে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করা যায়।'
এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত এমন একটি নতুন জাত তৈরি হয়েছে, যা অন্য আপেলের তুলনায় দুই মাস আগে পাকতে শুরু করে এবং রং ধারণ করে।
তবে এটা সবে শুরু। ড. ঠাকুর বলেন, 'আমরা এমন আপেল চাচ্ছি, যা শুধু টিকে থাকবে না, স্বাদেও যেন ভারতীয় ভোক্তাদের রুচির উপযোগী হয়।'
তবে গবেষণা একাই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ চন্দ্রশেখর।
তিনি বলেন, 'আপেল উৎপাদন বাড়াতে হলে বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা দরকার। যেসব অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে আপেল চাষ হয়, সেসব বাগানের গাছ এখন ১৫-২০ বছরের পুরোনো। নতুন চারা রোপণ তাই জরুরি।'
তবে তার প্রশ্ন, 'এই শিল্পে যে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ দরকার, সেই বিনিয়োগ করবে কে?'
চন্দ্রশেখরের মতে, আপেল দিয়ে তৈরি জুস, জ্যাম ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দিকে মনোযোগ দিলে এই শিল্প আরও মজবুত হতে পারে।
তিনি বলেন, 'এই খাত শুধু আপেল অর্থনীতিকেই চাঙা করবে না, ফলচাষিরাও এতে আরও লাভবান হবেন।'