কয়েন ও নোট সবই আছে, তবু ব্যবহার নেই চীনে; ‘বিলুপ্তির পথে’

বাইরে তখনও ঘুমঘোর ভোর। বেইজিং শহরের শিনমিন এলাকায় তাজা শাকসবজি বাজারে তখনও মানুষের ঢল নামতে শুরু করেনি, দোকানিরাও ধীরে ধীরে সময় নিয়ে নিজেদের পসরা সাজিয়ে নিচ্ছেন, ঠিক তখনই দেখা মেলে কয়েকজন বয়স্ক ক্রেতার। তারা হাতে করে নিয়ে আসেন কিছু কয়েন বা কাগুজে নোট।
পুরো চীনে নগদ লেনদেন যখন প্রায় বিলুপ্তির পথে, তখন তারাই যেন এর শেষ প্রজন্ম।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে খ্যাত চীন এখন কার্যত পুরোপুরি ডিজিটাল। শহরের সুপারমার্কেট, ক্যাফে, ট্যাক্সি কিংবা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট—সবখানেই লেনদেন চলে মূলত দুটি অ্যাপে: উইচ্যাট ও আলিপে।
দোকানের সামনে সারি সারি ঝুলে থাকে সবুজ আর নীল লোগোর বোর্ড। অনেক প্রতিষ্ঠান তো এখন আর ক্যাশ রেজিস্টারই রাখে না—ক্রেতা শুধু ফোনে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেই লেনদেন সম্পন্ন।
বাড়ির পাশের ছোট মুদি দোকান থেকে শুরু করে ট্যাক্সিচালক পর্যন্ত অনেকেই এখন আর নগদ নিতে চান না। অনেক সময় খুচরো টাকাও থাকে না তাদের কাছে।
হুবেই অঞ্চল থেকে আসা মা দিয়ান নিজ স্টলে ব্লুবেরি সাজাচ্ছিলেন, তিনি কাজ করেন শিনমিন বাজারে ফল ও সবজি বিক্রেতা হিসেবে। গত দশকে পরিবর্তনটা কতটা দ্রুত হয়েছে, সেটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটা একেবারে আমূল পরিবর্তন। এখন আমি শুধু বয়স্কদের কথা ভেবে নগদ নিই। ৮০ বছরের নিচে যারা, প্রায় সবাই মোবাইলে পেমেন্ট করে। তবে তার ওপরে যারা, তাদের পক্ষে মানিয়ে নেওয়া কঠিন।'
উইচ্যাট-আলিপের আধিপত্যে বয়স্কদের বিভক্তি
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ৮১ বছর বয়সী ওয়ে ইউনলিয়াং স্বীকার করলেন, তিনি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। ধূসর ক্যাপ আর চশমার আড়ালে বললেন, 'সবকিছু খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমার ছেলে আর ৮ বছরের নাতিও আমার ফোনে উইচ্যাট আর আলিপে ইনস্টল করে দিয়েছে, কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও জটিল।'
ট্যাক্সি ডাকতে হলেও তিনি এখন পরিবারের সাহায্য নেন। কারণ আগের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর গাড়ি পাওয়া যায় না; চীনের 'উবার' খ্যাত 'দিদি' অ্যাপে বুকিং ছাড়া গাড়ি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেক সময় এটি নিয়ে বিপাকে পড়েন বিদেশি পর্যটকরাও—এয়ারপোর্ট থেকে শহরে পৌঁছাতে হলে আগে থেকে অ্যাপ ডাউনলোড ও অর্থ স্থানান্তর করতে হয় না হলে গাড়ি পাওয়া বেশ মুশকিল।
তবে কয়েক কদম দূরের একটি স্টলে, ৭৫ বছর বয়সী ওয়াং জানান সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, 'টাকাগুলো এখন আর গুনে গুনে বের করতে হয় না, এটিই আমার কাছে আগের চেয়ে অনেক সহজ মনে হয়।'
মহামারির সময় যখন অনেক দোকান কেবল ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করতে শুরু করে, তখনই তিনি এই ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যান।
ওয়াং এর মতে,'এখন আর বিকল্প কোনও উপায় নেই।' তবুও নিরাপত্তার খাতিরে তিনি সবসময় পকেটে ১০০ ইউয়ানের একটি নোট রাখেন (প্রায় ১ হাজার ৬০০টাকা )—এতে ফোন হারিয়ে গেলে বা ভুলে গেলে অন্তত বাসায় ফেরার ভরসা থাকে।
তিনি আরও জানান, এখন অনলাইনে তিনি ভার্টিক্যাল ভিডিও দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এমনকি সি-ফুড রান্নার টিপসও নেন 'লাইভস্ট্রিমার'দের কাছ থেকে। যেসব মাছ কিনতে দ্বিধা বোধ করেন, সেগুলোর রেসিপি দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেন।
একসময় সাধারণ একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে শুরু হওয়া উইচ্যাট এখন চীনাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাবার অর্ডার, ট্যাক্সি ডাকা, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ—সবই করা যায় এর ভেতরের অসংখ্য 'মিনি-প্রোগ্রাম'-এর মাধ্যমে। অন্যদিকে, আলিবাবার মালিকানাধীন আলিপে মূলত একটি পেমেন্ট টুল।
এই দুই অ্যাপের মাধ্যমে চীনে ব্যাংকিং কার্যক্রম অনেকটাই পেছনের কাতারে চলে গেছে। যদিও বেতন পেতে এখনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি এবং এই অ্যাপগুলোর সঙ্গে একটি কার্ড সংযুক্ত করতে হয়, তবুও অনেক তরুণ চীনার দৈনন্দিন লেনদেনে ব্যাংকের কোনো ভূমিকা নেই—যতক্ষণ না তারা গৃহঋণের মতো বড় কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে চান।
চীনের সব ব্যাংকই রাষ্ট্রায়ত্ত হলেও, উইচ্যাট ও আলিপে-এর আগ্রাসী ডিজিটাল আধিপত্যের সঙ্গে তারা তাল মেলাতে পারছে না। সাধারণ লেনদেনে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে গেছে।
ডিজিটাল ইউয়ান
চীনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে আলিবাবা এই সাফল্যে কিছুটা উদ্ধত হয়ে ওঠলেও, টেনসেন্টের সিইও মা হুয়াতেং সবসময়ই পেছনে থেকে কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্বকে সম্মান জানিয়ে চলেছেন।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে, আলিবাবার আর্থিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যান্ট-এর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আইপিও ঘোষণার কয়েক দিন আগে, আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন এবং তাদের 'পুরোনো' পদ্ধতিতে উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ তোলেন। এরপর বেইজিং ওই আইপিও বাতিল করে এবং জ্যাক মার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তিনি কয়েক মাস জনসমক্ষ এড়িয়ে চলেন, বিদেশেও সময় কাটান।
তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এমন পরিস্থিতি বদলাতে থাকে, যখন জ্যাক মা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অন্যান্য প্রযুক্তি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন বিষয়টি মীমাংসার পথে এগোয়।
উইচ্যাট ও আলিপের সীমাহীন আধিপত্যের প্রতিক্রিয়ায় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বিটকয়েনসহ বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈশ্বিক বিস্তারকে 'অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের জন্য হুমকি' হিসেবে দেখেছিল বেইজিং। এই প্রেক্ষাপটেই ২০১৪ সাল থেকে পিপলস ব্যাংক অব চায়না ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় চালু হয় ডিজিটাল ইউয়ান বা ডিজিটাল রেনমিনবি (e-CNY)। এই মুদ্রা প্রচলিত ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়, তবে এটি সম্পূর্ণ কাগুজে রূপহীন—একটি নিখাদ ডিজিটাল লেনদেন মাধ্যম। এর নিয়ন্ত্রণ থাকে রাষ্ট্রের হাতে, আর ইস্যু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই।
২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি শহরে পরীক্ষামূলকভাবে এটি চালু করা হয়। ২০২২ সালে আসে অফিশিয়াল স্মার্টফোন অ্যাপ। সে সময় চীনা কর্তৃপক্ষ জানায়, ২৬ কোটিরও বেশি অ্যাকাউন্ট এ অ্যাপে খোলা হয়েছে। তবে বাস্তবে কতজন মানুষ নিয়মিত এটি ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে আর বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি চীনা সরকার।
তবে বাস্তবতা হলো, দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল ইউয়ানের ব্যবহার এখনো প্রায় অদৃশ্য। কারণ মানুষ এর চেয়ে অনেক বেশি ভরসা করে উইচ্যাট ও আলিপের 'সুবিধা' ও 'স্বাচ্ছন্দ্যের' ওপর।
রাজনীতির ফাঁদে ডিজিটাল মুদ্রা
তবে সাধারণ জনগণের মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণে অনাগ্রহের পাশাপাশি, দেশটির রাজনৈতিক সংকটও দায়ী।
গত বছর এপ্রিল মাসে চীনের ক্ষমতাধর কমিউনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা তদারকি সংস্থা জানায় যে, চীন সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশনে(সিএসআরসি) এক কর্মকর্তা ইয়াও ছিয়ানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, তিনি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ইয়াও ছিলেন ডিজিটাল ইউয়ান চালুর লক্ষ্যে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা কার্যক্রমের দায়িত্বে। অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনি এই ঘুষ লেনদেন গোপন করতে ব্যবহার করেছেন ডিজিটাল মুদ্রা নিজেই।