বাংলাদেশের এক বড় ভুল: প্রতিশোধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সংস্কারের সঙ্গে

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হতে চলেছে। কয়েক সপ্তাহের সেই অস্থিরতায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং আহত হন আরও অনেকে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বছরের পর বছর ধরে অপশাসনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় আসে।
তবে, এগারো মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এখনও রাজনৈতিক বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ সমঝোতা করার চেয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করতে বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়ন সহায়তা ও বাণিজ্য সুবিধা কমিয়ে দেওয়ায় অর্থনীতি চাপে পড়েছে; অন্যদিকে প্রতিবেশী ও এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চরম অবনতির দিকে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—১৭ কোটির বেশি মানুষের এই দেশ কি তার 'নতুন সূচনার' সুযোগ নষ্ট করে ফেলছে?
তবে মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদী। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৮৪ বছর বয়সী এই নেতা বলেন, 'বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত গভীর সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবেই। অর্থনীতির দিক থেকে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।'
'এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবে, জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪.২ শতাংশ থেকে কমে ৩.৯ শতাংশে নামলেও তা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, এবং বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি গত বছরের জুলাইয়ে প্রায় ১২ শতাংশ থাকলেও এবার মে মাসে কমে ৯ শতাংশে এসেছে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে খেলাপি ঋণ কমানোর কাজ শুরু করেছে এবং বিগত সরকারের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল অর্থের খোঁজে তদন্ত জোরদার করেছে।'
এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এডিবি সম্প্রতি কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। তবে এডিবির চন্দন সাপকোটা সতর্ক করে দিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সরকার যেসব সংস্কার করেছে, তা মূলত 'সহজ বিষয়' বা 'লো-হ্যাংগিং ফ্রুট'। অথচ বাংলাদেশ এখনো মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, দেশের অবকাঠামো দুর্বল এবং তরুণদের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতির কারণে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
অর্থনীতিতে কিছুটা সাফল্য মিললেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ড. ইউনূস বলেছেন, 'বাংলাদেশ সবার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করছে।' কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত মার্চে তার প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর হয় চীনে, যেখানে কয়েকটি চুক্তিও সই হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে জে১০সি ও জেএফ১৭ যুদ্ধবিমান কিনতে পারে। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পাকিস্তান এই বিমানগুলো ব্যবহার করেছিল। এমনকি ১৯ জুন চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম ত্রিপাক্ষিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এসব ঘটনার ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত এখন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। যদিও জনমত ভিন্ন: গত বছরের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশি চীনকে ইতিবাচকভাবে দেখে; বিপরীতে মাত্র ১১ শতাংশ ভারতকে পছন্দ করে।
তবু একটি বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঝুঁকিপূর্ণ। এপ্রিলে ভারত বাংলাদেশের জন্য যে ট্রান্স-শিপমেন্ট সুবিধা দিচ্ছিল, তা বাতিল করেছে। ফলে ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহার করে রপ্তানির পথ এখন খরচসাপেক্ষ হয়ে উঠবে।
এদিকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একসময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী ছিল; বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে অর্থসাহায্য করত। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার।
গত মাসে বাংলাদেশ সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য আলোচনায় বসেছে, কারণ আগামী ৯ জুলাই থেকে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এটি এড়ানোই এই আলোচনার মূল লক্ষ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—এই দেশ কত দ্রুত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারবে? এবং ফিরলেও, সেটি কতদিন টিকবে?
ড. ইউনূস সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এর আগে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চান, যার নাম 'জুলাই সনদ'। এই দলিল নির্বাচনের নীতিমালা নির্ধারণ করবে এবং নির্বাচনের পর যে সরকার আসবে, তাদের জন্য জরুরি সংস্কারের একটি রোডম্যাপও নির্ধারণ করবে। তবে এই সনদে কী ধরণের শর্ত অন্তর্ভুক্ত হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৫০টি রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন করেছে; যা আগের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। নতুন দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্তর্বর্তী সরকার তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করতে চায়—সেই বিবেচনায় এটিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই নতুন ও ছোট দলগুলোর ভালো করার সম্ভাবনা খুব কম। একটি জনমত জরিপ বলছে, যারা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট দিতে চান এনসিপিকে। বরং পুরনো রাজনীতির ধারায় থাকা দলগুলোর সমর্থন অনেক বেশি: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) পেয়েছে ৪২ শতাংশ এবং ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ৩২ শতাংশ।
উদারপন্থীরা আশঙ্কা করছেন, ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এলে ধর্মীয় মৌলবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বাড়তে পারে। অন্যদিকে বিএনপিকে নিয়েও জনমনে সংশয় আছে; অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের মতোই এই দলটিও দুর্নীতিগ্রস্ত ও আত্মতুষ্ট।
তবে সবচেয়ে বড় সংকট সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি। কয়েক মাসের চাপের পর, চলতি বছরের মে মাসে সরকার 'জাতীয় নিরাপত্তা'র কারণ দেখিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকার বলছে, এই সিদ্ধান্ত সাময়িক, আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করছে। কিন্তু মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।
এ অবস্থায় অনেক ভোটারই মনে করছেন, তাদের সত্যিকারের রাজনৈতিক পছন্দের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নিষিদ্ধ হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ এখনো জনসমর্থন ধরে রেখেছে। জরিপে দেখা গেছে, যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশের প্রথম পছন্দ আওয়ামী লীগ। যদিও পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি বাস্তব সংখ্যার চেয়ে কম। অনেকেই হয়তো প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে ভয় পাচ্ছেন। দলটির নেতা মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, 'দেশের অর্ধেক জনগণ এখনো আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল।'
আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে, গত বছরের 'গণ অভ্যুত্থানের' পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৪ জন নেতা-কর্মী পুলিশি হেফাজতে নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে 'স্বেচ্ছাচারীভাবে' আওয়ামী লীগ সমর্থকদের টার্গেট করার অভিযোগ এনেছে, যা 'পূর্ববর্তী সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর দমন-পীড়নের প্রতিচ্ছবি'।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর আইনবিদ আরাফাত খান মনে করেন, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে সমগ্র জাতিকে এক করতে হবে। তার ভাষায়, 'বাংলাদেশের এখন একটি 'নেলসন ম্যান্ডেলা মুহূর্ত' দরকার।'