হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ পাঠাতে অনীহা ট্যাঙ্কার মালিকদের, জানালেন ফ্রন্টলাইন প্রধান

ইরানে ইসরায়েলের হামলার জেরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় হরমুজ প্রণালী দিয়ে উপসাগরে নতুন করে জাহাজ পাঠানোর চুক্তি থেকে সরে আসছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তালিকাভুক্ত তেলবাহী ট্যাঙ্কার কোম্পানি ফ্রন্টলাইন।
শুক্রবার সংঘাত শুরুর পর বৈশ্বিক শিপিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে—এমন আশঙ্কার প্রাথমিক ইঙ্গিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে ফ্রন্টলাইনের প্রধান নির্বাহী লার্স বারস্টাডের এই সিদ্ধান্তকে।
উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্তকারী ইরান ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী এখন সবার উদ্বেগের কেন্দ্রে। বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ তেলের জোগান এবং এক-তৃতীয়াংশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এই পথেই পরিবাহিত হয়। এছাড়া দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দরকেন্দ্রিক কনটেইনার জাহাজ চলাচলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ রুট।
বারস্টাড বলেন, 'এই অঞ্চলে ঢোকার জন্য এখন খুবই কম সংখ্যক মালিক চার্টার নিচ্ছেন, আমরাও না। আমরা উপসাগরে ঢোকার চুক্তি করছি না, এটা এখন হচ্ছে না।"
সমুদ্র নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও বলছেন, জাহাজমালিকরা হরমুজ প্রণালী এড়িয়ে চলতে চাইছেন, কারণ এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে বারস্টাড জানান, ফ্রন্টলাইন কোম্পানির একাধিক ট্যাঙ্কার আগে থেকেই উপসাগরে অবস্থান করছে এবং সেগুলো নিরাপত্তা জোরদার করে, আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর নিরাপত্তা বহরের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রণালী পেরিয়ে বের হয়ে আসবে।
তিনি বলেন, 'বাণিজ্য এখন আরও অকার্যকর হয়ে উঠবে এবং নিশ্চয়ই নিরাপত্তারও মূল্য আছে।'
ইরান এই রুটে চলাচলে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এমনকি দেশটি ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের (ইরান সমর্থিত) লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক জাহাজে হামলার মাত্রা বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের বিপ্লবী গার্ড হরমুজ প্রণালীর কাছ থেকে এমএসসি এরিয়াস নামের একটি কনটেইনার জাহাজ আটক করে তা ইরানের জলসীমায় নিয়ে যায়। জাহাজটি ছিল ইসরায়েলের ওফার পরিবারের নিয়ন্ত্রিত জোডিয়াক মেরিটাইমের সঙ্গে সংযুক্ত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোরটাল শিপিং-এর মালিকানাধীন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে হুথিদের হামলা শুরু হলে অনেক বড় শিপিং কোম্পানি এশিয়া-ইউরোপের প্রচলিত সুয়েজ খালপথ ছেড়ে দক্ষিন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে বিকল্প পথে যাওয়া শুরু করে।
শুক্রবার বিমা এজেন্টরা জানান, লোহিত সাগর হয়ে মালামাল পরিবহনের বিমা খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
এক বিমা এজেন্ট বলেন, 'হুথি বিদ্রোহীদের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, জলদস্যুতা ও অন্যান্য ঝুঁকির কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর জন্য বিমা খরচ এতটা বেড়েছে। ইসরায়েল এই সপ্তাহের শুরুতে হুথি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনের হোদেইদা বন্দর শহরে হামলা চালায়।'
সরবরাহ শৃঙ্খলা সংক্রান্ত তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান জেনেটা-এর প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড বলেন, 'চলমান উত্তেজনার কারণে কনটেইনার জাহাজগুলো আবার আগের পথে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।'
শিল্পজাত পণ্য পরিবহনকারী কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলো বিশেষভাবে লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলে অনাগ্রহী।
স্যান্ড আরও বলেন, যদি জাহাজ কোম্পানিগুলো দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দরকে হাব হিসেবে বাদ দিয়ে উপসাগরের বাইরে কম সুবিধাসম্পন্ন বন্দরে যাওয়া শুরু করে, তাহলে অনিবার্যভাবেই শিপিং বিঘ্নিত হবে এবং বন্দরজট সৃষ্টি হবে।'
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ইরান হরমুজ প্রণালীতে কার্যত এক ধরনের 'অঘোষিত অবরোধ' আরোপ করতে পারে।
তবে বারস্টাড মনে করেন না, ইরান সম্পূর্ণভাবে জলপথটি বন্ধ করবে। কারণ তেল রপ্তানির ওপর দেশটির প্রবল নির্ভরতা রয়েছে। 'তারা নিজেদের অর্থের উৎস নষ্ট করতে চাইবে না,' বলেন তিনি।
তবে তিনি বলেন, হামলার পর ইরানের স্বাভাবিক তেল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। যার ফলে চীনসহ ইরান-নির্ভর দেশগুলোকে বিকল্প উৎসে যেতে হতে পারে। এতে ফ্রন্টলাইনের মতো মূলধারার ট্যাঙ্কার কোম্পানিগুলো লাভবান হতে পারে।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ইরান 'ডার্ক ফ্লিট' বা অস্বচ্ছ নীতিতে পরিচালিত জাহাজ ব্যবহার করে তেল রপ্তানি করে। তবে চীনসহ যারা বিকল্প খুঁজবে, তাদের আন্তর্জাতিক মান-সম্পন্ন জাহাজেই তেল আমদানি করতে হবে বলে বারস্টাড উল্লেখ করেন।
এদিকে, শুক্রবার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে ফ্রন্টলাইনের শেয়ারদর ৭.৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।