১৭ বছর মকবুল ফিদা হুসেনের শিল্পকর্ম বাজেয়াপ্ত করে ব্যাংকের ভল্টে ফেলে রাখে ভারত

দুই দশক ধরে ব্যাংকের ভল্টে বন্দি ছিল ভারতীয় কিংবদন্তি শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের ২৫টি দুর্লভ চিত্রকর্ম। অবশেষে সেগুলো আলো দেখতে যাচ্ছে। ১২ জুন মুম্বাইয়ের পুনডোল আর্ট গ্যালারিতে এই চিত্রকর্মগুলোর নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আসবে এই মাস্টারপিসগুলো, যেগুলো একসময় ছিল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত আর্ট ডিলের অংশ।
বিবিসি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চিত্রশিল্পী ফিদা হুসেনের হাতে এই ছবিগুলো ২০০০ সালের শুরুর দিকে আঁকা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ চিত্রকর্ম তিনি মুম্বাইয়ের পুনডোল গ্যালারির স্টুডিওতেই আঁকেন। গ্যালারির পরিচালক দাদিবা পুনডোল বলেন, "চিত্রগুলো যেন আবার জীবনে ফিরে এসেছে।"
এই ২৫টি ছবির সিরিজটির নাম দেওয়া হয়েছে 'এমএফ হুসেন: একজন শিল্পীর চোখে বিশ শতক'। এখানে উঠে এসেছে প্রযুক্তি, রাজনীতি আর সংস্কৃতির রূপান্তরময় শতকের নানা রূপ। গ্যালারির ধারণা, নিলামে এগুলোর মূল্য উঠতে পারে প্রায় ২৯ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।

ফিদা হুসেন ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত আধুনিক চিত্রশিল্পীদের একজন যাকে 'ভারতীয় পিকাসো' বলেও ডাকা হতো। তার সাহসী বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, শিল্পের দুনিয়ায় তার কদর ছিল বিপুল। ২০১১ সালে ৯৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি।
এই নিলাম আসছে এমন এক সময়ে, যখন হুসেনের আরেকটি স্বল্প পরিচিত চিত্রকর্ম 'গ্রাম যাত্রা' গত মার্চে নিউ ইয়র্কে ক্রিস্টির নিলামে ১৩.৮ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয় যা ভারতীয় কোনো শিল্পকর্মের জন্য নতুন রেকর্ড। ছবিটি দীর্ঘদিন নরওয়ের এক হাসপাতালে ঝুলে ছিল, শিল্প জগৎ যেন ভুলেই গিয়েছিল তার অস্তিত্ব।
পুনডোল বলেন, "যখন হুসেন ছবি আঁকতেন, তখন চারপাশের কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারত না। তিনি থাকতেন একাগ্র।"
২০০৪ সালে এই ২৫টি চিত্রকর্ম হুসেন বিক্রি করেন মুম্বাইয়ের এক ব্যবসায়ী গুরু স্বরূপ শ্রীবাস্তবের কাছে। পুরো ১০০টি ছবির সিরিজের এটি ছিল প্রথম কিস্তি। আর্ট দুনিয়ায় তখন এই চুক্তিকে বলা হচ্ছিল ভারতের 'সবচেয়ে বড় আর্ট ডিল'। এক বিলিয়ন রুপি মূল্যের এই চুক্তি হুসেনের সঙ্গে করেন সেই ব্যবসায়ী, যিনি আর্ট সার্কেলে একেবারে নতুন মুখ হলেও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

তবে সেই উল্লাস বেশিদিন টেকেনি। ২০০৬ সালে ভারতের সিবিআই তদন্ত শুরু করে শ্রীবাস্তবের আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে। অভিযোগ ওঠে, সরকার-সমর্থিত একটি কৃষি উন্নয়ন সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন তিনি । শ্রীবাস্তব ও তার প্রতিষ্ঠান যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে, মামলা এখনো চলছে আদালতে।
২০০৮ সালে একটি ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত দেয়, শ্রীবাস্তবের কাছ থেকে এক বিলিয়ন রুপি মূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যাবে। এর মধ্যেই ছিল সেই ২৫টি চিত্রকর্ম। এরপর এগুলো ব্যাংকের ভল্টে বন্দি পড়ে ছিল দীর্ঘ সময়।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে আদালত নিলামের অনুমতি দেয়। এরপরই শুরু হয় ছবিগুলোর 'আলোয় ফেরা'।
২০১৮ সালের এক সাক্ষাৎকারে শ্রীবাস্তব বলেন, "প্রথম ২৫টি চিত্রকর্ম বিক্রি করে আমি ফিদা হুসেনকে বাকিগুলোর মূল্য দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালে তিনি আমাকে লন্ডন ও প্যারিসে তৈরি ছবিগুলো নিতে বলেছিলেন, কিন্তু তখন আমার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। তিনি বিষয়টা বুঝেছিলেন।"
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কেন একজন অজানা ব্যবসায়ীর হাতে নিজের দামী ছবিগুলো তুলে দিলেন হুসেইন? পুনডোল বলেন, "তিনি এসব ব্যাপারে ভাবতেন না। তার একটাই চিন্তা , ছবিগুলো বিক্রি হচ্ছে কি না।"
হুসেন এই ২০ শতকের সিরিজ শেষ করতে পারেননি। কিন্তু তার ঝলমলে কর্মজীবনের এক রহস্যময় অধ্যায় হয়ে থাকবে এই চুক্তি।
এই ২৫টি চিত্রকর্ম অ্যাক্রিলিক দিয়ে ক্যানভাসে আঁকা। প্রতিটি ছবিতে ফুটে উঠেছে হুসেনের সাহসী শৈলী আর বিশ শতকের বড় বড় ঘটনা। এক ছবিতে দেখা যায় এক অদ্ভুত দলের বেঞ্চে বসে আড্ডা, পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্বশান্তির আহ্বান যেন বোঝায় এই ছবিটি। আরেক ছবিতে চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে রাখা হয়েছে রকেট উৎক্ষেপণের দৃশ্য,যা বৈষম্য ও অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের এক অনবদ্য তুলনা।

আরও কিছু ছবিতে দেখা যায় দারিদ্র্যপীড়িত পৃথিবী, ট্রেঞ্চে যুদ্ধরত সৈনিক, এবং মানবজাতির কষ্টের ইতিহা্স যা তুলে ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উপমহাদেশের বিভাজন, ও হলোকাস্ট।
এখন সেই নিঃসঙ্গ ব্যাংক ভল্ট থেকে বেরিয়ে তারা ফিরে আসছে আলোয়, গ্যালারির দেয়ালে, ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা