লাওহে ওয়া কালাম: চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা স্মরণে দোহায় উদ্বোধন হলো জাদুঘর
কাতারের রাজধানী দোহার এক প্রান্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ধূসর-নীল রঙের নতুন একটি ভবন। সূর্যের আলোয় এর টাইলস ঝিকমিক করে, আর জ্যামিতিক নকশায় তৈরি ছায়াগুলো ভবনের ওপর খেলতে থাকে। এমনভাবে নকশা করা হয়েছে ভবনটি, যেন এটি সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে—মনে হয় যেন কোনো গল্প শুনিয়ে দিতে উদগ্রীব।
এটি কিংবদন্তি ভারতীয় চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন বা এম এফ হুসেনের স্মরণে নির্মিত বিশ্বের প্রথম জাদুঘর—'লাওহে ওয়া কালাম'। জীবনের শেষ সময়টি হুসেন কাটিয়েছিলেন কাতারে; ২০১০ সালে দেশটির নাগরিকত্বও পান। তার স্মৃতি, কাজ ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই এই জাদুঘর নির্মিত হয়েছে।
কাতার ফাউন্ডেশনের 'এডুকেশন সিটি'র বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় ৩ হাজার বর্গমিটার জায়গায় জাদুঘরটির অবস্থান। গত সপ্তাহে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এর ভেতরে দেড় শতাধিক শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে; রয়েছে মকবুল ফিদা হুসেনের চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র, ট্যাপেস্ট্রি এবং দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র। এগুলো শিল্পীর দীর্ঘ কর্মজীবনের ব্যাপ্তি, চিন্তা ও শেষ বয়সের মানসিক জগতকে একসাথে তুলে ধরে।
জাদুঘরের কিউরেটর নুফ মোহাম্মদ জানান, হুসেন সবসময় চেয়েছিলেন তার জাদুঘরটি যেন দর্শনার্থীদের কাছে 'ঘর'-এর মতো আপন মনে হয়। তিনি বলেন, 'আমরা চাই দর্শনার্থীরা পৃথিবীকে সেভাবেই অনুভব করুক, যেভাবে শিল্পী নিজে করতেন—ঘনিষ্ঠভাবে, প্রাণবন্তভাবে এবং গভীরভাবে।'
এম এফ হুসেনের আঁকা গতিময় ও শক্তিশালী ঘোড়ার চিত্রকর্মগুলো আধুনিক শিল্প জগতে বিশেষ সমাদৃত। এগুলোর বিক্রয়মূল্যও কোটি কোটি ডলারে পৌঁছেছে। তাকে প্রায়ই 'ভারতের পিকাসো' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আধুনিক কিউবিজমের সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের রঙ, রূপ ও প্রতীকের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি ক্যানভাসে অনন্য প্রাণসঞ্চার করতেন। চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি দুটি বলিউড চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছিলেন, যদিও সেগুলো বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি।
তবে বিতর্ক তাকে সারাজীবন অনুসরণ করেছে। হিন্দু দেবীদের নগ্ন ছবি আঁকার কারণে তিনি কট্টরপন্থীদের তীব্র সমালোচনা ও হুমকির মুখে পড়েন। অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান।
নিজ দেশে সাংস্কৃতিক সংঘাত ও বহু বছরের অস্থিরতার পর কাতারে এসে তিনি শিল্পচর্চায় নতুন করে মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন। এই সময়টি তার জন্য ছিল এক ধরনের সৃজনসমৃদ্ধ নবজাগরণ।
কাতারি শিল্পী ইউসুফ আহমেদ, যিনি শিল্পীর জীবনের শেষ বছরগুলোতে তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন, বিবিসিকে বলেন, 'তিনি এখানে কাজের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে থাকতেন। আরব ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতি তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় যে জীবনের শেষদিকে তার সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ও বড় প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল এখানেই, কাতারে।'
'লাওহে ওয়া কালাম' জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণগুলোর একটি হলো 'সিরু ফি আল আরধ' (ভূপৃষ্ঠে বিচরণ)—একটি বিশাল মাল্টিমিডিয়া প্রকল্প, যা নিয়ে হুসেন জীবনের শেষ বছরগুলোতে কাজ করেছিলেন। গতি, শব্দ ও যান্ত্রিক নকশার ব্যবহার করে মানবসভ্যতার কাহিনি বলাই ছিল এই প্রকল্পের মূল ভাবনা।
জাদুঘরের ভবনটিও নির্মিত হয়েছে হুসেনের ২০০৮ সালের একটি স্কেচ বা নকশার ভিত্তিতে। স্কেচে দেখা যায় উজ্জ্বল নীল-ধূসর রঙের একটি গঠন একটি সিলিন্ডার আকৃতির টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেন ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কাতার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যৌথভাবে ভবনটির নকশা করেন ভারতীয় স্থপতি মার্তন্ড খোসলা। তিনি একে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চ্যালেঞ্জের স্মৃতি টেনে বলেন, তার হাতে ছিল কেবল একটি স্কেচ—'একটি স্কেচে তো ভবনের মাপজোখ থাকে না, থাকে শুধু ধারণা বা ইচ্ছা। আর সেই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া ছিল একেবারেই আলাদা চ্যালেঞ্জ।'
হুসেনের স্কেচকে তিনি নকশা হিসেবে নয়, বরং দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, 'কোন অংশটুকু বাস্তবে রূপ দিতে হবে আর কোনটুকু রূপকের মতো ব্যবহার করতে হবে—এই ভাবনাটাই ছিল সবচেয়ে বড় অনুসন্ধান।'
তিনি বলেন, 'এটি ছিল অনেকটা স্থাপত্যের নতুন এক ভাষা তৈরির মতো।' এভাবে ভবনের ভেতরে তৈরি হয়েছে গোলকধাঁধার মতো পথঘাট, যা দর্শনার্থীদের অনবরত ঘুরে দেখতে উৎসাহিত করে—যেন তারা হুসেনের তুলির রেখা অনুসরণ করে এগোচ্ছেন।
খোসলা বলেন, 'আমরা আশা করি, হুসেনের ম্যুরালের মতোই এই জাদুঘরও দর্শনার্থীদের প্রতিবার ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে।'
প্রতিটি গ্যালারির শুরুতেই রাখা হয়েছে শিল্পীর একটি করে উক্তি, যা দর্শনার্থীদের তার চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। লম্বা করিডোর ধরে এগোলেই চোখে পড়ে তার আঁকা বিভিন্ন ছবি, ভাস্কর্য এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের দ্রব্যাদি—যার মধ্যে রয়েছে তার পুরোনো ভারতীয় পাসপোর্টও। এসব উপস্থাপন করে এমন এক শিল্পী, চলচ্চিত্র–নির্মাতা ও দার্শনিকের গল্প, যিনি পৃথিবী চষে বেড়ালেও ভারতকে কখনো ভোলেননি। আর স্বভাবতই, হুসেনের প্রিয় ঘোড়ার ছবিগুলো জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ।
কিউরেটর নুফ মোহাম্মদ জানান, 'আমরা হুসেনের ড্রাইভার, সহযোগী এবং বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা করেছি তার জীবনের অজানা গল্পগুলো তুলে আনতে—যাতে বোঝা যায় ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন।'
কাতারি শিল্পী আহমেদ মনে করেন, এ জাদুঘর হুসেনকে নিয়ে প্রচলিত বিতর্ক বা লোককথার বাইরে গিয়ে শিল্পীর প্রকৃত মানস জগতকে চিনতে সাহায্য করবে। অনেকেই তাকে খালি পায়ে হাঁটা, সাদা লম্বা চুলের এক খামখেয়ালি ও বিতর্কিত শিল্পী হিসেবে মনে রেখেছেন। আহমেদ যোগ করেন, 'কিন্তু তিনি আসলে ছিলেন এক জিনিয়াস—যিনি গল্প বলতে ভালোবাসতেন; সে গল্প পুরাণের হোক, আধুনিকতার হোক কিংবা স্মৃতির।'
হুসেনের জীবনের এক কম পরিচিত অধ্যায়ও এখানে তুলে ধরা হয়েছে—উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থানের সময় তার ইসলামি গ্রন্থ ও আরব ইতিহাসের প্রতি গভীর আগ্রহ।
২০০৮ সালে কাতার ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন শেখা মোজা বিনতে নাসের তাকে একটি বৃহৎ প্রকল্পের দায়িত্ব দেন। দোহার একটি স্টুডিওতে বসে তিনি আরব সভ্যতা, ইসলামি ইতিহাস, বিশ্বাস ও মানব বিবর্তন নিয়ে বিস্তৃত এক সিরিজ আঁকেন।
কিউরেটর নুফ মোহাম্মদ বলেন, 'এর মধ্যে বদর যুদ্ধ নিয়ে আঁকা ছবিটি ইসলামি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে তুলে ধরে। এটি তার গতি ও রঙ-নৈপুণ্যের দৃষ্টান্ত, যেখানে তিনি ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক আখ্যানকে নিজস্ব ভঙ্গিতে মিশিয়েছেন।'
এই প্রকল্পের জন্য হুসেনকে ৯৯টি চিত্রকর্ম তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি ৩৫টি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। সেগুলো এখন জাদুঘরের সংগ্রহে আছে এবং পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে।
তার ভারতীয় কাজের পাশাপাশি এসব উপসাগরীয় কাজ উপস্থাপনের মাধ্যমে জাদুঘরটি শুধু হুসেনের ঐতিহ্য উদযাপন করছে না, বরং তাকে এক নতুন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরছে।
স্থপতি মার্তন্ড খোসলা বলেন, হুসেনের শেকড় ছিল ভারতে, তবে তার শিল্প–দৃষ্টি ও কাজ বিভিন্ন ভূখণ্ড ও ইতিহাসের প্রভাব বহন করত। তিনি বলেন, 'তিনি একাধিক পরিচয়ের ধারক ছিলেন একইসঙ্গে; আর এই বৈচিত্র্যই প্রকল্পটিকে করেছে আরও সমৃদ্ধ।'
