২০০ চিত্রকর্মে ফিরে দেখা ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক ইতিহাস

১৬০০ সালে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ধীরে ধীরে সেটিই রূপ নেয় এক পরাক্রমশালী ঔপনিবেশিক শক্তিতে। ১৮ শতকের শেষভাগে ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসন আরও দৃঢ় হতে থাকে। সেই সময় তাদের অনেক কর্মকর্তা ভারতবর্ষের শিল্পীদের কাজে লাগাতে শুরু করেন তাদের শাসনামলের নানান চিত্র আঁকার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল নতুন শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দেশের প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতি আর স্থাপত্যকে তুলে ধরা। শিল্পীদের অনেকে আগে মুঘল দরবারে কাজ করতেন। প্রতিবেদন বিবিসি নিউজের।
দিল্লি আর্ট গ্যালারিতে চলছে ঔপনিবেশিক চিত্রকর্মের প্রদর্শনী 'আ ট্রেজারি অব লাইফ: ইন্ডিয়ান কোম্পানি পেইন্টিংস, ১৭৯০ থেকে ১৮৩৫'। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে ২০০-র বেশি শিল্পকর্ম যেগুলো এতদিন ছিল মূলধারার শিল্প ইতিহাসের বাইরে। এটাই এখন পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে বড় ঔপনিবেশিক ইতিহাসের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী।

এই শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশই অজানা শিল্পীদের আঁকা। বিষয়ের বৈচিত্র্যও বিস্ময়কর। তিনটি মূল বিভাগে ফেলা যায় এগুলোকে। প্রাকৃতিক ইতিহাস যেমন উদ্ভিদ-প্রাণীর ছবি, প্রাচীন স্থাপত্য বা শহরের দৃশ্য, আর ভারতীয় আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি।
প্রদর্শনীর কিউরেটর জাইলস টিলটসনের ভাষায়, 'এই বিষয়গুলোতে ইউরোপীয়দের আগ্রহ ছিল প্রবল,' তিনি বলেন, 'ভারতবর্ষে এসে তারা নতুন গাছপালা, প্রাণী আর অজানা রকম স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মানুষের পোশাক-আশাক, আচরণ, জীবনধারা সবই ছিল তাদের কাছে ভিন্ন। ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারেন, এর পেছনে আছে ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার গভীর প্রভাব।'

প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বাইরেও ভারতের স্থাপত্য ঐতিহ্য মোহিত করেছিল ইউরোপীয়দের। সেই সময় ক্যামেরা ছিল না। তাই ভ্রমণের স্মৃতি ধরে রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল ছবি আঁকা। আর তাই মুঘল স্থাপত্য হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় বিষয়। তাজমহল ছাড়াও চিত্রিত হয়েছে আগ্রা দূর্গ, জামা মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, ফতেপুর সিক্রির শেখ সেলিম চিশতির সমাধি, দিল্লির কুতুব মিনার এবং হুমায়ুনের সমাধি।
এসব শিল্পকর্মে অবদান রেখেছেন দেশীয় চিত্রশিল্পীরাও। তাদেরই একজন ছিলেন দীর্ঘদিন নাম না জানা শিল্পী সীতা রাম। ফতেপুর সিক্রির সমাধির নকশা আঁকেন তিনি। ১৮১৪ সালের জুন থেকে ১৮১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত, সীতা রাম ভ্রমণ করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ফ্রান্সিস রডন ওরফে মারকুইস অব হেস্টিংসের সাথে । এই ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্রায় এক দশক এই পদে ছিলেন।
প্রদর্শনীতে যেসব শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছে জলরঙে আঁকা গাছপালার ছবি। ধারণা করা হয়, এগুলোর উৎস মুর্শিদাবাদ কিংবা মৈদাপুর (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে)। মুর্শিদাবাদ একসময় ছিল বাংলার নবাবদের রাজধানী। সেখানেই কার্যক্রম চালাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮ শতকের শেষ দিকে মুর্শিদাবাদের পাশের এলাকা মৈদাপুরে সাময়িকভাবে ঘাঁটি গড়ে তোলে ব্রিটিশরা। তবে পরে কলকাতার উত্থানে এই এলাকার গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায়।
এই ছবিগুলো মূলত লুইসা পার্লবি অ্যালবামের অংশ। ব্রিটিশ নারী লুইসা পার্লবি নিজ হাতে এগুলো সংকলন করেছিলেন । তার স্বামী, কর্নেল জেমস পার্লবি, তখন ভারতবর্ষে কর্মরত ছিলেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোলাস রথ লিখেছেন, 'এই চিত্রগুলোতে যেসব গাছপালা দেখা যায়, তা সম্ভবত মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের বাগান, মাঠঘাট, রাস্তার পাশ ও খোলা জায়গায় সহজেই মিলত।' তিনি আরও বলেন, 'এইগুলো পরিচিত, ব্যবহৃত ও চাষযোগ্য উদ্ভিদ। স্থানীয় মানুষের জীবনের অংশ ছিল এগুলো। কিন্তু ইউরোপীয়রা এসবকে দেখেছিলেন সংগ্রহযোগ্য 'বিলাসী উদ্ভিদ' হিসেবে।'

একটি চিত্রকর্মে ধরা পড়েছে দক্ষিণ ভারতের এক মন্দির শোভাযাত্রার মুহূর্ত। সেখানে দেখা যাচ্ছে শিবের একটি প্রতিমা, অলংকৃত মঞ্চের উপর স্থাপিত। সেটি বহন করছেন কয়েকজন পুরুষ। প্রতিমার পাশে ব্রাহ্মণ ও শিঙাবাদকদের উপস্থিতি দৃশ্যটিকে আরও বর্ণিল করে তুলেছে। শোভাযাত্রার সামনে রয়েছে কাঠি হাতে নৃত্যরত শিল্পীরা। তাদের মাথার উপর থেকে ঢালা হচ্ছে পবিত্র জল। সবকিছুই ঘটছে এক অস্থায়ী প্রাঙ্গণের নিচে। চিত্রটির নাম 'ঔরিকাটি তিরুনাল'। এটি দক্ষিণ ভারতের করাইকালের তিরুনাল্লার মন্দিরের উৎসবের একটি বিশেষ রীতি তুলে ধরেছে। দুই শতক পুরনো এই ঐতিহ্যের এমন মুহূর্ত চিত্রকর্মে দেখা বিরল এক ঘটনা।
১৮ শতকের শেষ দিকে ইউরোপীয় ক্র্রেতা আর ভারতবর্ষের শিল্পীদের পারস্পরিক সহায়তায় আরও বিস্তৃত হয় ভারতবর্ষের শিল্পকর্ম। শিল্প ইতিহাসবিদ মিলড্রেড আর্চার একে বলেছেন 'ভারতবর্ষের সামাজিক জীবনের এক মনোমুগ্ধকর দলিল।' এইসব চিত্রকর্মে মিশেছে মুঘল মিনিয়েচার বা ক্ষুদ্র প্রতিরূপ শিল্পের মতো সূক্ষ্মতা ও ইউরোপীয় বাস্তবধর্মী চিত্রায়ন। এতে আরও যুক্ত হয়েছে নানান আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। যেমন তাঞ্জোরের শিল্পীদের আঁকায় উঠে এসেছে বিচিত্র বর্ণের ও পেশার মানুষ। যেমন নৃত্যশিল্পী, বিচারক, সিপাহী, তাড়ি সংগ্রাহক আর সাপুড়ে।

দিল্লী আর্ট গ্যালারির কানুপ্রিয়া শর্মা বলেন, 'এইসব চিত্রকর্ম ব্রিটিশদের কৌতূহল মেটাত। একইসঙ্গে ইউরোপীয় দর্শকদের কাছে ভারতের 'বৈচিত্র্যময়তা' ছিল রোমাঞ্চকর, এই চিত্রকলা তা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল।' কোম্পানি চিত্রকলার আলোচনা প্রায়শই ঘুরপাক খায় ব্রিটিশ ক্রেতার মধ্যেই। তবে দক্ষিণ ভারতবর্ষের চিত্রটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। সেখানে ১৭২৭ সাল থেকেই ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিতেন ফরাসিরা। তারই এক চমকপ্রদ উদাহরণ পুদুচেরি থেকে সংগৃহীত ৪৮টি চিত্রকর্মের এক সেট। সমান আকার ও একই রকম শৈলীতে আঁকা। ১৮০০ সালের দিকে ফরাসি সংগ্রাহকরা কী ধরনের কাজ চাইতেন, তার এক নিখুঁত নিদর্শন এই সিরিজ।

একটি ছবিতে দেখা যায়, টুপি ও লুঙ্গি পরা দশজন পুরুষ ঢেউয়ের মধ্যে নৌকা বেয়ে চলেছেন। ছবির ক্যাপশনে ফরাসি ভাষায় লেখা— 'নাজ্যর', অর্থাৎ সাঁতারুরা। নৌকাটিকে বলা হয়েছে 'শিল্যাংগ'। এই সিরিজে সবচেয়ে নজরকাড়া চিত্র দুটি এঁকেছেন 'বি' নামে এক শিল্পী। তার ছবিতে ধরা পড়েছে করমণ্ডল উপকূলের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে নৌকা চালানোর দৃশ্য। মাদ্রাজ বা পুদুচেরির আশপাশে ছিল না নিরাপদ কোনো বন্দর। এই অঞ্চলে পণ্য ও যাত্রী পারাপারের একমাত্র ভরসা ছিল দক্ষ মাঝিরা। তাদেরই ভরসায় ইউরোপীয় বাণিজ্য টিকে ছিল উপকূলের ভয়ংকর ঢেউয়ের মাঝেও।

কোম্পানি চিত্রকলায় প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা। আঁকা হয়েছে পাখি, জন্তু আর গাছপালার ছবি যার বেশিরভাগই ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা বা সংগ্রহ থেকে নেওয়া। দিল্লী আর্ট গ্যালারির প্রদর্শনীতে দেখা যায়, ছবির মূল প্রানী বা উদ্ভিদটি সাধারণত আঁকা হতো বাস্তব মাপে । সাদা পটভূমিতে তুলে ধরা হতো তাকে। মাঝেমাঝে পটভূমিতে দেখা যেত হালকা ঘাসের দৃশ্য। এতে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকতো মূল বিষয়বস্তুর ওপরেই।
দিল্লী আর্ট গ্যালারির সিইও আশীষ আনন্দ বলেন, এই প্রদর্শনী কোম্পানি চিত্রকলাকে 'ভারতবর্ষের আধুনিকতার' সূচনা হিসেবে দেখছে। ' তার ভাষ্যে, ' তখন রাজদরবার বা মন্দিরের প্রশিক্ষিত শিল্পীরা প্রথমবার বাইরে এসে নতুন ক্রেতাদের জন্য কাজ শুরু করে। এই নতুন ক্রেতাদের উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। তারা রাজনীতি বা ধর্মের অনুগামী ছিলেন না। তাদের লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণ। ' আশীষ আনন্দ আরও বলেন, 'ক্রেতারা বিদেশি ছিলেন। কিন্তু আসল কথা হলো ভারতবর্ষের শিল্পীরা তাদের চাহিদার জবাবে ভারতবর্ষের শিল্পভাষার একেবারে নতুন রূপ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। '
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা