পাকিস্তানের ব্যবহৃত পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র এড়াতে জ্যামিং হতে পারে প্রধান সহায়

পাকিস্তানের সঙ্গে গত মে মাসের সংঘাতে একদিনে তিন তিনটি রাফালসহ অন্তত পাঁচটি যুদ্ধবিমান হারায় ভারত। এনিয়ে দিল্লির পক্ষ থেকে যথেষ্ট লুকোচুরিও করা হয়, বিমান হারানোর ঘটনা ভারতের সরকার ও গণমাধ্যম— কেউই দীর্ঘসময় পর্যন্ত স্বীকার করেনি। পরে দেশটির সামরিক বাহিনী এবিষয়ে নিশ্চিত করেছে। যদিও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
তাছাড়া এখনো দুই পক্ষ থেকেই যাচাইযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ঘটনার প্রাথমিক রিপোর্ট যদি সত্য হয়, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে—পাকিস্তানের ব্যবহৃত চীনের নতুন এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল পিএল-১৫-এর কার্যকারিতা কতখানি?
পিএল-১৫ একটি 'বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ' (বিভিআর) ক্ষেপণাস্ত্র, আমেরিকার অ্যামর্যাম বা ফ্রান্সের মিটিওর এর সমপর্যায়ের মিসাইল। প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানকে পাইলটের দৃষ্টিসীমার বহুদূর থেকে ঘায়েল করতে এসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে অপরপক্ষের যুদ্ধবিমান। পিএল-১৫ উচ্চগতির, শক্তিশালী একটি মিসাইল, যার গতি মাক ৫ (শব্দের গতিবেগের পাঁচগুণ) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে—যা হাইপারসনিক গতির প্রাথমিক স্তর।
এই ক্ষেপণাস্ত্রে রয়েছে ডুয়েল-পালস ইঞ্জিন। প্রথম পালসটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের সময় সক্রিয় হয়, যা মিসাইলটিকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত করে। লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছালে, যখন প্রথম ইঞ্জিনের শক্তি কমে আসে, তখন দ্বিতীয় পালস আবার গতি বাড়িয়ে মিসাইলটিকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ঠেলে দেয়।
এই ডুয়েল পালস প্রযুক্তিই পিএল-১৫-এর মারাত্মক সক্ষমতার অন্যতম কারণ। উচ্চগতি এবং পুনরুদ্ধারযোগ্য শক্তি, মিসাইলের লক্ষ্যবস্তু বা শত্রুর ফাইটার জেটকে পালিয়ে যাওয়ার তেমন সুযোগই দেয় না।
রাশিয়া ও চীন বরাবরই তাদের যুদ্ধবিমানের 'ম্যানুভারেবিলিটি' বা কৌশলগত গতিশীলতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ যুদ্ধবিমান এফ-৩৫, তেমন নয়। তবে এফ-২২ এর ব্যতিক্রম, কারণ এটি নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টেলথ বা রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিমানের গতিশীলতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর একটি কারণ হচ্ছে, স্টিলথ বিমানের অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন প্রধানত রাডার এড়িয়ে চলার জন্য তৈরি—বিশেষ করে এক্স-ব্যান্ডের রাডারকে ফাঁকি দিতে।
অন্যদিকে, রাশিয়ান যুদ্ধবিমানগুলোর ইঞ্জিন থ্রাস্ট-ভেক্টরিং প্রযুক্তিসম্পন্ন, যার ফলে তারা দ্রুত এবং তীক্ষ্ণ গতিবিধি করতে পারে।
রাশিয়ার সুখই-৫৭ বিমানে ব্যবহৃত এএল-৪১এফ১ ইঞ্জিনে রয়েছে থ্রাস্ট ভেক্টরিং নোজল এবং ইন্টিগ্রেটেড ফ্লাইট ও প্রপালশন কন্ট্রোল সিস্টেম—এই প্রযুক্তি এখনো এফ-৩৫-এ যুক্ত করা হয়নি।
প্রতিরক্ষাখাত সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকাশনায় বলা হয়েছে, ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ), যারা ফরাসি রাফাল ও রাশিয়ান সুখই-৩০ উভয় ধরনের যুদ্ধবিমান চালায়, তারা অন্তত ৮টি পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রকে এড়াতে পেরেছে।
ভারতের মাটিতে পাওয়া গেছে প্রায় সম্পূর্ণ অক্ষত পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রের অংশবিশেষ। কয়েকটি দেশ লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ এসব ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে—এরমধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয়নি বলেও জানা গেছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যবস্তুতে লাগল না এবং বিস্ফোরিতও হলো না?
প্রথম পর্যায়ে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রকে গাইড করে উৎক্ষেপণকারী বিমানের রাডার বা কোনও এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম বা এঅ্যাওয়াকস বিমান। একদম শেষ ধাপে পিএল-১৫ নিজস্ব এসা রাডার স্বীকার ব্যবহার করে, যার দৃষ্টিকোণ সীমিত।
ভারতের রয়েছে উন্নত রাডার জ্যামিং প্রযুক্তি। রাফাল বিমানে রয়েছে নিজস্ব ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম 'স্পেকট্রা'।
ভারতের সুখই-৩০এমকেআই বিমানগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে রাশিয়ান 'তারাং' রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার এবং ইসরায়েলি জ্যামার পড ইএল/এম ৮২২২। ইসরায়েল এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ এর একটি শাখা এলটার নির্মিত এই জ্যামার অ্যাক্টিভ ফেজড অ্যারে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা শত্রুর হুমকি শনাক্ত করে এবং নিখুঁতভাবে জ্যাম করতে পারে।
জ্যামিং প্রযুক্তির ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এই প্রযুক্তি বহু পুরনো হলেও এর আধুনিক রূপ আজ অনেক বেশি কার্যকর। যদিও কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে এই জ্যামার কতটা কার্যকর ছিল, তবু এটা স্পষ্ট যে চীনের বিভিআর ক্ষেপণাস্ত্র, এমনকি পিএল-১৫-এর মতো উন্নত মডেলও জ্যামিংয়ের কাছে দুর্বল।
ধারণা করা হচ্ছে, পিএল-১৫ ও চীনের অন্যান্য বিভিআর মিসাইলের এসা রাডার এবং গাইডেন্স সিস্টেমগুলো একই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে, একটিতে এই দুর্বলতা পাওয়া গেলে— অন্যগুলোতেও এই দুর্বলতা আছে বলে ধরা যেতেই পারে।
ভবিষ্যতে যখন এই অবতরণ করা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্লেষণ করা হবে, এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী তাদের ফরাসি ও রাশিয়ান সহযোগীদের সঙ্গে নিজস্ব অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে, তখন আরও অনেক কিছু জানা যাবে। রাশিয়া হয়তো মুখ খুলবে না, তবে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের মিত্রদের সঙ্গে এসব তথ্য শেয়ার করতে পারে।
যদি বিভিআর প্রযুক্তির মিসাইলকে জ্যামিংয়ের মাধ্যমে দুর্বল করে ফেলা যায়, তাহলে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাইকেই নতুন করে ভাবতে হবে।
যেমন পেন্টাগন তাদের পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ ও অন্যান্য চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের জন্য মূলত বিভিআর প্রযুক্তির ওপরই ভরসা রেখেছে। তাহলে কি পিএল-১৫ মিসাইলে যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তা মার্কিন বিভিআর ক্ষেপণাস্ত্রেও থাকতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর যত দ্রুত পাওয়া যাবে, পেন্টাগনের জন্য ততই ভালো। জ্যামার প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আরও উন্নত করা এখন সময়ের দাবি—এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি বিশ্বের প্রতিরক্ষা নীতিতেও এই দিকটিকে গুরুত্ব দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: স্টিফেন ব্রিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির নিকটপ্রাচ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সাবেক স্টাফ ডিরেক্টর।