মারা গেছেন কিংবদন্তি আফ্রিকান সাহিত্যিক গুগি ওয়া থিয়োঙো

৮৭ বছর বয়সে মারা গেছেন গুগি ওয়া থিয়োঙো। কারাগার, নির্বাসন কিংবা অসুস্থতাও কখনো কলম থামাতে পারেনি আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের এই কিংবদন্তি লেখকের। খবর বিবিসি'র।
দীর্ঘ ছয় দশকজুড়ে তার বিস্তৃত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন কেনিয়ার পরিবর্তনের ইতিহাস—একটি উপনিবেশ থেকে গণতন্ত্রে রূপ নেওয়ার যাত্রা।
বহুবারই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য গুগির নাম আলোচনায় এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই পুরস্কারটি হাতছাড়া হওয়ায় ভক্তরা হতাশ হয়েছেন।
তবে কেবল নোবেল পাওয়ার যোগ্য লেখক হিসেবেই নয়, আফ্রিকার দেশগুলোর নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য রচনার পক্ষে দাঁড়ানো এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ হিসেবেও গুগি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
১৯৩৮ সালে তিনি জেমস থিয়োঙো গুগি নামে জন্মগ্রহণ করেন। তখন কেনিয়া ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। তিনি লিমুরু শহরে বেড়ে ওঠেন। কৃষিকাজে যুক্ত নিম্নবিত্ত এক বড় পরিবারে তার জন্ম।
তার বাবা-মা অনেক কষ্ট করে তাকে ব্রিটিশ মিশনারিদের পরিচালিত বোর্ডিং স্কুল 'অ্যালায়েন্স'-এ পড়তে পাঠান।
এক সাক্ষাৎকারে গুগি বলেন, একবার সেমিস্টার শেষে 'অ্যালায়েন্স' স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন, তার পুরো গ্রামটিই ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ ধ্বংস করে দিয়েছে।
তার পরিবারের সদস্যদেরও তখন 'মাউ মাউ' আন্দোলন দমনে পরিচালিত অভিযানের অংশ হিসেবে শত শত মানুষের সঙ্গে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছিল।
১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চলা মাউ মাউ বিদ্রোহ গুগির জীবনে বহু দিক দিয়ে গভীর ও মর্মান্তিক প্রভাব ফেলেছিল।
এই বিদ্রোহ তার জীবনে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ছাপ ফেলে এক ঘটনায়—তার ভাই গিতোগোকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে এক ব্রিটিশ সৈনিক। কারণ, সৈনিকের আদেশ অমান্য করেছিলেন গিতোগো।
কিন্তু গিতোগো আদেশটি শুনতে পাননি—তিনি ছিলেন শ্রবণপ্রতিবন্ধী।
১৯৫৯ সালে যখন ব্রিটিশরা কেনিয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন গুগি পড়াশোনার জন্য উগান্ডায় পাড়ি জমান। তিনি ভর্তি হন আফ্রিকার অন্যতম খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাকারেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেখানে এক লেখক সম্মেলনে গুগি তাঁর প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ভাগ করে নেন খ্যাতনামা নাইজেরিয়ান সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের সঙ্গে। আচেবে সেটি যুক্তরাজ্যের প্রকাশকের কাছে পাঠান। পরে ১৯৬৪ সালে 'উইপ নট, চাইল্ড' নামে বইটি প্রকাশিত হয় এবং সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। এটি ছিল পূর্ব আফ্রিকার কোনো লেখকের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি ভাষার উপন্যাস।
এরপর গুগি দ্রুত দুটি জনপ্রিয় উপন্যাস লেখেন—'এ গ্রেইন অব হুইট' ও 'দ্য রিভার বিটুইন'। ১৯৭২ সালে যুক্তরাজ্যের 'টাইমস' পত্রিকা লিখেছিল, ৩৩ বছর বয়সী গুগিকে আফ্রিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এরপর আসে ১৯৭৭—গুগির জীবন ও সাহিত্যকর্মে এক বড় মোড়। ওই বছরই তিনি নিজের নাম বদলে 'গুগি ওয়া থিয়োঙো' রাখেন। উদ্দেশ্য ছিল, ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্ত একটি পরিচয় নেওয়া। একই সঙ্গে ইংরেজি ছেড়ে কিকুয়ু মাতৃভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নেন।
সে বছরই তিনি লেখেন নিজের শেষ ইংরেজি উপন্যাস 'পেটালস অব ব্লাড'। আগের বইগুলোতে তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের সমালোচনা করলেও, এই উপন্যাসে তিনি স্বাধীন কেনিয়ার নতুন শাসকদের নিশানা করেন। তাদের তুলে ধরেন সাধারণ মানুষকে ছেড়ে যাওয়া এক অভিজাত শ্রেণি হিসেবে।
তবে এখানেই থেমে থাকেননি গুগি। একই বছর তিনি সহ-লিখিত নাটক 'নগাহিকা নডেনদা' (আই উইল মেরি হোয়েন আই ওয়ান্ট)-তে কেনিয়ার শ্রেণি বৈষম্যের কঠোর চিত্র তুলে ধরেন।
নাটকটির মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোমো কেনিয়াটার সরকার। এরপর গুগিকে কোনো বিচার ছাড়াই এক বছর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে বন্দি রাখা হয়।
তবে ওই এক বছর ছিল ফলপ্রসূ। সেখানেই তিনি লেখেন তার প্রথম কিকুয়ু ভাষার উপন্যাস 'ডেভিল অন দ্য ক্রস'। বলা হয়, খাতা না থাকায় পুরো উপন্যাসটি তিনি লিখেছিলেন টয়লেট পেপারে।
ড্যানিয়েল আরাপ মুই প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গুগিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
চার বছর পর, লন্ডনে একটি বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়ে গুগি জানতে পারেন—তিনি কেনিয়ায় ফিরলে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে, পরে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। ২২ বছর পর তিনি দেশে ফেরেন।
দেশে ফিরে তিনি নায়কের মতো অভ্যর্থনা পান—তাকে স্বাগত জানাতে হাজির হন হাজারো কেনিয়ান।
তবে সেই ফিরে আসা আনন্দময় ছিল না। দুর্বৃত্তরা তার ফ্ল্যাটে ঢুকে গুগিকে নৃশংসভাবে মারধর করে এবং তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে।
গুগি এই হামলাকে 'রাজনৈতিক' বলে দাবি করেন।
পরে তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। সেখানে তিনি ইয়েল, নিউ ইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া আরভাইনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
শিক্ষা ও সাহিত্যে গুগি আফ্রিকান ভাষায় সাহিত্যচর্চার অন্যতম জোরালো কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তার জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে আফ্রিকান সাহিত্যে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় লেখা বই-ই ছিল প্রধান—যা আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশের সরকারি ভাষা।
'আফ্রিকা ঔপনিবেশিকতাকে ছাড়তে পারে না' এমন কথা বলা রাজনীতিকের সঙ্গে 'আফ্রিকা ইউরোপীয় ভাষা ছাড়া টিকতে পারে না' এমন কথা বলা লেখকের পার্থক্য কী?—এ প্রশ্ন গুগি করেছিলেন তার বহুল আলোচিত প্রবন্ধসংগ্রহ 'ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড'-এ।
সেই গ্রন্থে গুগি তার সাহিত্যজীবনের সহায়কদের একজন চিনুয়া আচেবে-কে , ইংরেজিতে লেখালেখির জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। এর ফলে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।
সাহিত্যজীবনের বাইরেও গুগির জীবন ছিল ঘটনাবহুল। তিনি দুইবার বিয়ে ও বিচ্ছেদ করেন। তার নয়টি সন্তান, যাদের মধ্যে চারজনই লেখক।
২০২০ সালে এলএ টাইমসকে গুগি বলেছিলেন, 'আমার নিজের পরিবারই এখন আমার সাহিত্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী।'
গুগি ওয়া থিয়োঙো-এর ছেলে মোকোমা ওয়া থিয়োঙো অভিযোগ করেছিলেন, তার মা তার বাবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে তিনি লেখেন, 'আমার ছোটবেলার কিছু স্মৃতি হলো, মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি যাওয়া—সেখানে তিনি আশ্রয় নিতেন।' এ বিষয়ে গুগি কখনো কোনো মন্তব্য করেননি।
জীবনের শেষভাগে গুগির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ২০১৯ সালে তার হৃদযন্ত্রে ট্রিপল বাইপাস সার্জারি হয় এবং পরে কিডনি জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৯৫ সালে ধরা পড়ে প্রোস্টেট ক্যানসার, তখন তাকে তিন মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
তবে গুগি সেই লড়াইও জয় করেন—নিজের দীর্ঘ সংগ্রামের তালিকায় ক্যানসারকেও যুক্ত করেন।
তবু শেষ পর্যন্ত নিভেই গেল আফ্রিকান সাহিত্যের এক দীপ্ত শিখা। নাইজেরীয় লেখক চিমামান্ডা নাগোজি আদিচির ভাষায়, 'আফ্রিকান সাহিত্যের পথপ্রদর্শক'—যার চলে যাওয়া শব্দের জগতে রেখে গেল এক শূন্যতা।