ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি জার্মানির

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন, মানবিক আইন লঙ্ঘনের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র ইসরায়েলকে আর রপ্তানি করবে না জার্মানি। তিনি ও চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জার্মানিও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরায়েল ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইসরায়েল নীতি পুনর্বিবেচনা করছে, তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কানাডাও গাজা নিয়ে 'কঠোর পদক্ষেপ' নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডাব্লিউডিআর-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োহান ওয়াডেফুল বলেন, 'ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির ঐতিহাসিক সমর্থন যেন অপব্যবহার না করা হয়।' গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা ও খাদ্য-ওষুধের ঘাটতি পরিস্থিতিকে 'অসহনীয়' করে তুলেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এর আগে ফিনল্যান্ডে এক সংবাদ সম্মেলনে চ্যান্সেলর মেৎর্স বলেন, 'হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে যুক্তিতে ইসরায়েল গাজায় হামলা চালাচ্ছে, তা আর গ্রহণযোগ্য নয়; এখন আর এসবের কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।'
এই অবস্থান সম্পর্কচ্ছেদের সমতুল্য না হলেও, জার্মান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি বড় পরিবর্তন। নাজি গণহত্যার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের প্রতি জার্মানির 'বিশেষ দায়' নীতির আলোকে এই পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ। জনমতেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট।
ওয়াডেফুল বলেন, 'ইহুদিবিদ্বেষবিরোধী সংগ্রামে আমাদের অঙ্গীকার এবং ইসরায়েলের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি সমর্থনকে গাজার যুদ্ধের যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সতর্কভাবে ভাবতে হবে।' তবে তিনি কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি।
'যেখানে আমরা ক্ষতির আশঙ্কা দেখব, সেখানে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করব এবং কোনো অবস্থাতেই এমন অস্ত্র সরবরাহ করব না যা দিয়ে আরও ক্ষতি হতে পারে,' বলেন ওয়াডেফুল। তিনি জানান, বর্তমানে কোনো নতুন অস্ত্র সরবরাহের অর্ডার বিবেচনায় নেই।
সরকারি অবস্থানের এই পরিবর্তন এসেছে এমন এক সময়, যখন ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, অস্ত্র রপ্তানি অব্যাহত থাকলে জার্মানি যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গাজায় খাদ্যসংকট চরমে
সম্প্রতি গাজায় একের পর এক হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, ২০ লাখেরও বেশি মানুষের এই ভূখণ্ডে অনাহার ও দুর্ভিক্ষ দিন দিন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
গত মার্চে ভেঙে পড়া স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি পুনরায় কার্যকর করতে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে এক আঞ্চলিক কূটনীতিক জানিয়েছেন, কাতারের দোহায় এখনো আলোচনা চলছে এবং একটি চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে চ্যান্সেলর মেৎর্স-এর বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে জিতে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে উপেক্ষা করে তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে জার্মানিতে স্বাগত জানাবেন।
ফিনল্যান্ডের তুর্কু শহরে মেৎর্স বলেন, 'গাজায় ইসরায়েলিদের ব্যাপক সামরিক হামলার পেছনে এখন আর কোনো যুক্তি দেখি না—এই হামলাগুলো সন্ত্রাস দমনকে কতটা সেবা দিচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।'
তাকে জার্মানি থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াডেফুল জানিয়েছেন, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মেৎর্স-এর নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা পরিষদে, যার বৈঠকগুলো গোপনীয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জানা গেছে, এই সপ্তাহেই চ্যান্সেলর নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলবেন।
জার্মানিতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রন প্রসোর মঙ্গলবার স্বীকার করেন, জার্মানদের উদ্বেগ তারা বুঝতে পারছেন। তবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। জেডডিএফ সম্প্রচারমাধ্যমকে তিনি বলেন, 'ফ্রিডরিখ মেৎর্স যখন ইসরায়েলের সমালোচনা করেন, আমরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনি, কারণ তিনি একজন বন্ধু।'
জার্মানিতে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিরোধিতা বাড়ছে। এই সপ্তাহে টাগেসশপিগেল পত্রিকায় প্রকাশিত সিভির এক জরিপে দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ জার্মান নাগরিক ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির বিরোধিতা করছেন।
আরেকটি জরিপে, যা মে মাসে বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেছে, দেখা গেছে—মাত্র ৩৬ শতাংশ জার্মান এখন ইসরায়েলকে ইতিবাচকভাবে দেখেন; ২০২১ সালে এই হার ছিল ৪৬ শতাংশ। একই জরিপে দেখা গেছে, মাত্র এক-চতুর্থাংশ জার্মান নাগরিক মনে করেন, ইসরায়েলের প্রতি তাদের বিশেষ কোনো দায় আছে। অন্যদিকে, ৬৪ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন, জার্মানির তাদের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।