ব্যাংক ধ্বংস, এটিএম কাজ করছে না, ধসে পড়েছে অর্থনীতি; গাজাবাসীর ভরসা এখন ‘টাকা মেরামতকারীরা’

ছায়া ঘেরা একটি ছোট গোল টেবিলে ইহাব আল-হাননাওয়ি কুঁজো হয়ে বসে আছেন একটি ছেঁড়া নোটের ওপর, এমন একটি কাজ করছেন যা যুদ্ধের আগে ছিলই না।
একটি টাপারওয়্যার কনটেইনার থেকে তিনি ময়লা টাকা খুঁজে বের করছেন—নানা রঙ ও মূল্যমানের ছেঁড়া টুকরো। সেখান থেকে মিলিয়ে নেওয়া এক টুকরো কেটে তিনি তাতে বিশেষ ধরনের আঠা লাগান, তারপর গ্রীষ্মের উষ্ণ রোদে শুকাতে দেন তার এই নতুন তৈরি 'নোটটিকে'।
এভাবেই এখন গাজা উপত্যকায় কিছু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ইসরায়েল গত বছরের অক্টোবরে হামলা শুরুর সময় গাজায় নতুন মুদ্রিত শেকেল পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই সেখানে প্রচলিত মুদ্রার সংকট দেখা দেয়। নতুন নোট আসা বন্ধ থাকায় গাজার জনগণ বাধ্য হয়ে পুরোনো টাকাই বারবার ব্যবহার করছে।
গাজা শহরের ২৭ বছর বয়সী হাননাওয়ি বলেন, 'এই কাগুজে টাকা প্রায় দুই বছর ধরে ঘুরেফিরে চলেছে, কিন্তু এর বদলে কোনো নতুন নোট আসেনি। অনেকের কাছে এমন ছেঁড়া আর জীর্ণ টাকা আছে, যেগুলো দিয়ে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কিনতে পারছে না।'
তিনি জানান, 'যখন ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে গেল আর নগদ টাকার ঘাটতি দেখা দিল, তখনই কাগুজে টাকাগুলো খারাপ হতে শুরু করল—ময়লা হলো, ছিঁড়ল, ক্ষয়ে গেল। আমি যতটা পারি, মানুষকে সাহায্য করি তাদের নোট মেরামত করে। কিছু নোট আবার ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায়, কিন্তু কিছু একেবারেই চলে না। যুদ্ধের আগে এই পেশা ছিল না—এই কাজটা যুদ্ধের কারণেই তৈরি হয়েছে।'
যুদ্ধ শুরুর আগেও গাজায় লেনদেনের বেশিরভাগ (৮০ শতাংশের বেশি) হতো হাতে হাতে নগদ অর্থে। তবে এখন সেই অর্থব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের মুখে। গাজার ৫৬টি ব্যাংকের সব শাখা ধ্বংস হয়ে গেছে। আগে যেখানে ৯৪টি এটিএম ছিল, এখন মাত্র ৩টি আংশিকভাবে কাজ করছে। দুই মিলিয়নের বেশি মানুষের জন্য এটুকুই ভরসা।
এই অবস্থায় অনেকেই ফাটা-ছেঁড়া নোট দিয়ে কেনাকাটা করতে না পেরে এগোচ্ছেন মেরামতের দিকে। এক ব্যক্তি এখন দিনে ৫০০ থেকে ৬০০টি নোট মেরামত করেন—যদি তা ঠিক করার মতো হয়। প্রতি নোট মেরামতে তিনি নেন ২ শেকেল, যা প্রায় ৪০ পেন্সের মতো।
তিনি বলেন, 'যদি কোনো নোট খুব বেশি নষ্ট হয়, আমি সোজাসাপটা বলে দিই—এটা আর ঠিক হবে না। যেটা চলার মতো নয়, সেটা আমি নিই না। নোটের অবস্থা বুঝে কাজ করি—ফাটা থাকলে টেপ দেই, দাগ থাকলে রাবার দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করি। আমাদের একটা বিশেষ আঠাও আছে, সেটা দিয়ে লাগিয়ে শুকাতে দিই। কখনও যদি কোনার অংশ না থাকে, তখন আমার কাছে থাকা অন্য ছেঁড়া নোট থেকে মিলিয়ে কেটে জোড়া লাগিয়ে দিই।'
ইসরায়েলি বোমা হামলা, স্থল অভিযান ও খাদ্য, জ্বালানি আর ওষুধের ওপর নিষেধাজ্ঞায় গাজার অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছে। এখন যা কিছু চলছে, তা মূলত চলছে রাস্তার হকার, দোকানপাট আর চুরি হয়ে আসা পণ্যের ফেরিওয়ালাদের ভরসায়।

শিল্প এলাকা, ব্যাংক আর কারখানা ধ্বংস বা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাজায় বেশিরভাগ মানুষ এখন বেকার বা নিঃস্ব। নগদ টাকার ঘাটতিতে লেনদেন এখন অনেকটাই চলে গেছে বিনিময় পদ্ধতির (বার্টার সিস্টেম) দিকে—এক জিনিসের বদলে আরেক জিনিস। আর তা হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে, কারণ যারা এখনও ডিজিটাল টাকা নগদে রূপান্তর করে দেয়, তারা ভয়ানক হারে কমিশন নিচ্ছে ।
গাজা শহরের আল-জালাআ স্ট্রিটের বাজারে থাকা সুহেইলা সাল্লাক বলেন, 'কেউ ফেসবুকে পোস্ট দেয়—বাচ্চার দুধের একটি কৌটার বিনিময়ে চাই এক ব্যাগ ছোলা বা মটর। আমি তাদের মেসেজ করি, একমত হই—শুধু বাঁচার জন্য।'
তিনি তার শেষ ২০ শেকেল দিয়ে সাত নাতি-নাতনির জন্য কিছু দরকারি জিনিস কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রেতারা ছেঁড়া টাকা নিতে রাজি হননি। সুহেইলা বলেন, 'মানসিকভাবে এটা সহ্য করা যায় না। আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই, শুধু ওই একটা ২০ শেকেলের নোট। ব্যাংক থেকে তুলতে গেলেও এত বেশি কমিশন কাটে যে সেটা অসম্ভব।'
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অর্থনীতি অনুষদের ডিন সামির আবু মুদাল্লাহ বলেন, 'বাজারে এখন প্রায় কোনো আসল কাগুজে টাকা নেই। মানুষ বাধ্য হয়ে ডিজিটাল ব্যালান্স দিয়ে কিছু লোক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক মানি-চেঞ্জারদের কাছ থেকে ছেঁড়া নোট নেয়। আর এজন্য দিতে হয় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন।'
তিনি আরও জানান, 'ব্যাংক অব প্যালেস্টাইনসহ কিছু ব্যাংক বলেছে যে পুরোনো নোট বদলে দেবে, কিন্তু এখনো সেটার বাস্তবায়ন হয়নি। দুঃখজনকভাবে কিছু ব্যবসায়ী এই সুযোগে একটু ছেঁড়া ৫ বা ১০ শেকেলের নোটও নিতে অস্বীকৃতি জানায়।'
গত বছর পশ্চিম তীরে অবস্থিত প্যালেস্টাইন মনেটারি অথরিটি গাজায় একটি নতুন ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। শুরুর দিকে এতে পাঁচ লাখ মানুষ যুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত এটি জনপ্রিয় হতে পারেনি। কারণ দোকানিরা এখনো কেবল নগদ টাকা নিতে চায়।
নগদের ঘাটতির এই সময়ে গাজাবাসীর জন্য চাহিদা-জোগান বলে আর কিছুই নেই। পশ্চিম গাজার বাসিন্দা, তিন সন্তানের বাবা বাস্তুচ্যুত নাজি শাবাত বলেন, 'কেবল টাকা ভাঙানোর জন্য আমি প্রায় ৫ কিলোমিটার হেঁটে গিয়েছিলাম, যাতে খাবার কিনতে পারি। নগদ দিই বা অ্যাপ ব্যবহার করি—দুই ক্ষেত্রেই কমিশন একেবারে চড়া।'
তিনি বলেন, 'যেভাবেই হোক, আমাদের পিষে ফেলা হচ্ছে। গাজার ভেতরেই ব্যবসায়ীরা আমাদের ওপর অনেক চাপ দিচ্ছে। মানুষ মানুষকে আরও বিপদে ফেলছে। গতকাল রান্নার কিছু উপকরণ কিনতে বের হয়েছিলাম। হাতে ৫০ শেকেল ছিল, কিন্তু সেটি নিতে রাজি এমন একজনকে খুঁজতেই আমাকে ছয়-সাতটি রাস্তা পেরিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। কেউ বলল তার কাছে খুচরা নেই, কেউ বলল নোটটা বেশি ছেঁড়া, আরেকজন বলল দাম অনেক বেড়ে গেছে।'
শাবাত জানান, প্রতিদিনই রাস্তায় দাম বেড়ে চলেছে। এক কেজি আটা এখন ৭০ শেকেল, আর ডিজিটাল পেমেন্ট না নেওয়ার কারণে এটাকে তুলতে গিয়ে দাম গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১৩০ শেকেল। পুরো বস্তা আটার দাম বেড়েছে ৩ হাজার ৬৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৮ পাউন্ড থেকে ৩২৫ পাউন্ডে। এক লিটার রান্নার তেলের দাম ছিল ১.৩০ পাউন্ড, এখন তা বেড়ে ১৫ পাউন্ড; আর এক কেজি টমেটো, যেটা আগে পাওয়া যেত ৪০ পেনসিতে, এখন তা ১৩ পাউন্ডে বিকোচ্ছে।
সালাক বলেন, 'আমি আমার নাতি-নাতনির জন্য ডায়াপার বা দুধ কিনে দিতে পারছি না। এটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এক ক্যান শিশুখাদ্যের দাম এখন ১৭০ শেকেল, আর এক প্যাক ডায়াপার বিকোচ্ছে ১০০ ডলারে—মানে ৭৩ পাউন্ডে।'
এখন গাজার বেশিরভাগ মানুষই নগদ টাকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত এবং সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক সপ্তাহে সেই সাহায্য নিতে গিয়ে নতুন করে তৈরি হওয়া বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। এসব কেন্দ্র পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আর সেগুলো ঘিরে রয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা।
গাজায় চলমান যুদ্ধের ২১ মাসে এখন পর্যন্ত ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু গত মে মাসের শেষ থেকে শুরু হওয়া নতুন কিছু সহায়তা কেন্দ্রে হামলায় প্রাণ গেছে আরও ৮০০ জনের। এ তথ্য জানিয়েছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
রোববার গাজার মধ্যাঞ্চলে পানির জার ভর্তি করার জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় এক ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন ১০ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ৬ জনই শিশু। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই তথ্য দিয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা 'ইসলামিক জিহাদ'-এর একজন 'সন্ত্রাসী'কে লক্ষ্য করে হামলা করছিল। কিন্তু 'প্রযুক্তিগত ত্রুটির' কারণে ক্ষেপণাস্ত্রটি লক্ষ্য থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ে। তারা বিষয়টি তদন্ত করছে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো যে ত্রাণ সরবরাহ করে, তা হামাস যোদ্ধারা চুরি করে নেয়, নিজেরা রেখে দেয় কিংবা বিক্রি করে যোদ্ধাদের অর্থ জোগাতে।
জাতিসংঘ গত জুন মাসে প্রায় ৪০০ বার ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ত্রাণ পাঠানোর জন্য সমন্বয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু এর ৪৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইসরায়েল প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। অন্যদিকে, ইসরায়েল নিজে থেকে প্রতিদিন ৩২ ট্রাক ত্রাণ পাঠাচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়া যুদ্ধবিরতির পর থেকে।
চলতি বছর টানা চার মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় একফোঁটা জ্বালানিও ঢোকেনি, যদিও প্রায় সব পরিষেবার জন্যই জ্বালানি অত্যন্ত জরুরি। বিদ্যুৎ না থাকায় বেকারি, হাসপাতাল, সমাজসেবা, পানি পরিশোধন কেন্দ্র ও মানবিক সংস্থাগুলোকে চালু রাখতে হয়েছে জেনারেটর দিয়েই।
এই সপ্তাহে অবশেষে কিছুটা জ্বালানি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যেটাকে জাতিসংঘ স্বাগত জানিয়েছে। তবে সংস্থাটি বলেছে, 'এটা দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয়।'
আবু মুদাল্লাহ বলেন, 'জ্বালানির এই সংকট অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ফিলিস্তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দাম বেড়েছে ৫৫০ শতাংশেরও বেশি। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমনকি চলাফেরাও এখন খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।'
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা থেমে আছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে গাজার অর্থনৈতিক সংকট আরও ভয়াবহ হবে, আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগও বাড়তেই থাকবে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়