কাশ্মীরে গোলাবর্ষণে নিহত মাদ্রাসাশিক্ষককে যেভাবে ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে প্রচার করল ভারতীয় গণমাধ্যম

তীব্র ক্ষোভ আর বেদনায় কাতর কণ্ঠে নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করেন ফারুক আহমেদ। তার ভাই মোহাম্মদ ইকবাল ছিলেন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার বাসিন্দা। পেশায় ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। গত ৭ মে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গোলাবর্ষণে প্রাণ হারান ইকবাল। খবর বিবিসির
ইকবাল যেদিন মারা যান, তার আগের রাত থেকেই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরসহ দেশটির বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা শুরু করে ভারত। মূলত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার জেরে এ হামলা চালানো হয়। পেহেলগামে হামলায় অন্তত ২৬ পর্যটক নিহত ও আরও ডজনখানেক আহত হন। যদিও পাকিস্তান এ হামলায় দায়ী নয় বলে দাবি করেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইকবাল ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জিয়া-উল-উলুম নামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। হামলায় সেখানেই প্রাণ হারান তিনি। ইকবালের মৃত্যু তার পরিবারের জন্য যেন এক ভয়াল দুঃস্বপ্নের শুরু। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে তার পরিবারের দুর্দশা দিন দিন বাড়ছেই।
ইকবাল নিহত হওয়ার পর কয়েকটি গণমাধ্যম তাকে 'সন্ত্রাসী' হিসেবে প্রচার করতে থাকে। যদিও পুলিশ স্পষ্ট করেছে যে ইকবাল কোনো 'সন্ত্রাসী' নয়।
এ বিষয়ে ফারুক বলেন, 'আমার ভাই ছিলেন একজন শিক্ষক। কেবল দাড়ি আর টুপি দেখেই তারা আমার ভাইকে 'সন্ত্রাসী' বানিয়ে দিল। এটা আমাদের কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোর মতো। আমরা তাকে (ইকবাল) চিরদিনের মতো হারিয়েছি। আর গণমাধ্যম তার নামে কলঙ্ক ছড়াচ্ছে। মৃতরা তো আর আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে না।'
ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবি করেন, বিমান হামলা শুরুর পর চারদিনের সীমান্ত সংঘাতে ইকবালসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, সংঘাতে তাদের ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে এসব মৃত্যুর কতটি সরাসরি গোলাবর্ষণের কারণে হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশি এই দুই দেশের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তান ও আরেকটি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে কাশ্মীর ইস্যুতে দুই প্রতিবেশি দেশ এ পর্যন্ত তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। চলতি মাসের শুরুতেও তারা আরেকটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল।
সম্প্রতি পেহেলগামে হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা যখন বাড়ছিল, তখন আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয় অনলাইনে। সেটি হলো ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের যুদ্ধ। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে টেলিভিশন সবখানেই ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল।

শুধু ইকবালের পরিচয় নিয়েই নয়, বরং আরও বিভিন্ন বিষয়ে গণমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এসব তথ্যের কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, সেটি বুঝতে পারাও দুই দেশের মানুষের জন্যই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। কারণ মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও এসব ভুয়া খবর প্রচার হচ্ছিল।
যেমন, ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে পাকিস্তানের তেল ও বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র করাচি বন্দর ধ্বংস হয়ে গেছে বলে প্রচার করা হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া খবর। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেই পরে এটি স্পষ্ট করা হয়।
কিছু খবর ছিল আরও বিভ্রান্তিকর। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও, যেখানে পাকিস্তানের একজন জেনারেল দাবি করছেন, তাদের দুটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে।
নিউজলন্ড্রি নামের একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মনীষা পান্ডে বলেন, 'গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এতটা মিথ্যা তথ্য আর যাচাইহীন খবর ছড়ানো রীতিমতো ভয়াবহ।'
তিনি আরও বলেন, দর্শক টানতে কিছুটা নাটকীয়তা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এবারের মতো এত 'অন্ধ আর দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন' আগে কখনও দেখা যায়নি।
ফারুক বলছিলেন, 'আমি জানি না, সংবাদমাধ্যমগুলো আমার ভাই সম্পর্কে এসব তথ্য কোথা থেকে পেল।'
তার প্রশ্ন- ''তারা (গণমাধ্যম) কাদের সঙ্গে কথা বলেছে? কী প্রমাণ আছে তাদের হাতে যে আমার ভাই 'সন্ত্রাসী'?''
৭ মে সকালে ইকবাল প্রতিদিনের মতো মাদ্রাসায় যান। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। দুপুরে ফেরত আসে তার প্রাণহীন নিথর দেহ। তাকে স্থানীয় একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অথচ ওই সময় ইকবালের পরিবার জানতই না যে যাকে তারা হারালেন, তাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবারের সদস্যরা যখন ইকবালকে হারিয়ে বিলাপ করছেন, যখন ইকবালের জানাজা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সে সময় গণমাধ্যমগুলো যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ইকবালকে 'সন্ত্রাসী' প্রমাণ করতে।

ইকবালকে দাফনের কয়েক ঘণ্টা পর তাদের এক আত্মীয় হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিও দেখতে পান। তাতে দেখা যায়, একটি সুপরিচিত গণমাধ্যমে ইকবালের ছবি দেখিয়ে প্রচার করা হচ্ছে যে ভারতীয় সেনা এক 'সন্ত্রাসী'-কে হত্যা করেছে।
খবরটি দেখে হতবাক হয়ে যায় ইকবালের স্বজনরা। ফারুক বলেন, ''আমরা হতবাক হয়ে যাই। এরপর একের পর এক ফোন আসতে থাকে। সবাই জানতে চাইছে গণমাধ্যম কেন বলছে ইকবাল 'সন্ত্রাসী?''
ইকবালকে নিয়ে এই মিথ্যা দাবি প্রচার করে জি নিউজ, এবিপি ও নিউজ ১৮-এর মতো বেশ কিছু স্বনামধন্য টেলিভিশন চ্যানেল। এ বিষয়ে জানতে চ্যানেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। একটি চ্যানেল দাবি করে, ইকবাল পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে থাকা 'সন্ত্রাসী ঘাঁটি'-তে ভারতীয় হামলায় নিহত হন। তারা আরও বলে, ইকবাল ছিল পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা'র সদস্য।
ভারতীয় গণমাধ্যমটির এই দাবিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ফারুক। তিনি বলেন, 'আমাদের পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে পুঞ্চ জেলায় বসবাস করছে। কীভাবে তারা (গণমাধ্যম) বলল আমার ভাই পাকিস্তানে থাকতেন? তাদের লজ্জা হওয়া উচিত।'
ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে ৮ মে পুঞ্চ জেলা পুলিশ একটি বিবৃতি দেয়। তারা স্পষ্ট জানায়, ইকবাল মাদ্রাসার কাছে সীমান্তে গোলাবর্ষণে নিহত হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'এ ধরনের ভুয়া খবরের তীব্র প্রতিবাদ জানায় পুঞ্চ পুলিশ। মৃত ব্যক্তি, মাওলানা মোহাম্মদ ইকবাল তাদের এলাকার পরিচিত ও সম্মানিত একজন ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। তার সঙ্গে কোনো 'সন্ত্রাসী' সংগঠনের সম্পর্ক ছিল না।'
আরও বলা হয়, 'যারা এই ভুয়া খবর ছড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
তবে ফারুক জানান, পুলিশের এই বিবৃতি এসেছিল অনেক দেরিতে। ততক্ষণে এই মিথ্যা খবর লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।
তার অভিযোগ, নিউজ ১৮ ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চায়নি। না পরিবারের কাছে, না দর্শকদের কাছে। তিনি এসব চ্যানেলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে এখন সেটা করতে পারছেন না তিনি।
ইকবালের ঘরে রয়েছেন দুই স্ত্রী ও আট সন্তান। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সরকার যে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, সেটি কয়েক লাখ রুপি হলেও ফারুক বলেন, 'এই টাকায় বড়জোর দুয়েকে বছর চলা যাবে। তারপর কী হবে? এখন থেকেই ভবিষ্যতের চিন্তা করতে হবে।'
''আমার ভাই ছিলেন গোটা পরিবারের ভরসা। শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন, শিশুদের পড়াতে ভালোবাসতেন। কিন্তু কে বলবে আমাদের এই গল্পটা? অনেকের চোখে এখনও সে (ইকবাল) একজন 'সন্ত্রাসী', যার মৃত্যু ন্যায্য। আমাদের কষ্ট তারা বুঝবে কীভাবে?''
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা