১০ সপ্তাহের অবরোধের পর গাজায় 'সামান্য' খাদ্য ঢুকতে দেবে ইসরায়েল

দশ সপ্তাহের অবরোধের পর গাজায় 'দুর্ভিক্ষজনিত সংকট' এড়াতে 'সামান্য পরিমাণ খাদ্য' প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। খবর বিবিসির।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সুপারিশ এবং হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েল জানায়, তারা গাজায় 'বিস্তৃত স্থল অভিযান' শুরু করেছে।
গাজায় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ প্রবেশে দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে জানিয়েছে, ২১ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতোমধ্যে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের ছবি ও বিবরণ সামনে এসেছে।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো ইসরায়েলের প্রতি 'তাৎক্ষণিক, ব্যাপক ও বাধাহীন' মানবিক সহায়তা পুনরায় চালুর আহ্বান জানান।
নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানায়, গাজার জনগণের জন্য 'সামান্য পরিমাণ খাদ্য' ঢুকতে দেওয়া হবে, যাতে 'দুর্ভিক্ষজনিত সংকট' তৈরি না হয়। এবং এটি যাতে 'অপারেশন গিডিয়ন'স চ্যারিয়ট'–এর কার্যক্রমে বিঘ্ন না ঘটায়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'হামাস যাতে এই সহায়তার নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেজন্য ইসরায়েল পদক্ষেপ নেবে।'
রোববার সকালে আইডিএফ জানায়, তারা গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে একটি হাসপাতালও রয়েছে। ইসরায়েল জানায়, তারা গাজায় আটক বন্দিদের মুক্তি ও হামাসকে পরাজিত করতেই অভিযান চালাচ্ছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, উত্তরের বেইত লাহিয়া ও জাবালিয়া শরণার্থী শিবির এবং দক্ষিণের খান ইউনিস শহরে হামলা হয়েছে।
হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় অন্তত ৬৭ জন নিহত এবং ৩৬১ জন আহত হয়েছে।
খান ইউনিসের এক নারী বিবিসিকে জানান, সেখানকার পরিস্থিতি 'অত্যন্ত করুণ'। তিনি বলেন, 'রাতভর বোমাবর্ষণের শব্দে ঘুমাতে পারিনি। ময়দা, গ্যাস ও খাবারের তীব্র সংকট চলছে।'
গাজার প্রধান জরুরি সেবা সংস্থা সিভিল ডিফেন্স জানায়, দক্ষিণের আল-মাওয়াসি শিবিরেও রাতভর হামলা হয়েছে। এই 'নিরাপদ অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুতদের ওপর হামলায় অন্তত ২২ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয়েছেন।
রোববার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি বড় এলাকায় খালি করার নির্দেশ দেয়, যেটিকে 'চূড়ান্ত সতর্কতা' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এতে জানানো হয়, 'যেখান থেকে রকেট ছোড়া হচ্ছে, এমন যেকোনো এলাকায় শক্তিশালী হামলা চালানো হবে।' লোকজনকে 'অবিলম্বে পশ্চিমে আল-মাওয়াসির পরিচিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দিকে সরে যেতে' বলা হয়েছে।
ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বিমান হামলার মধ্যে উত্তর গাজায় তিনটি সরকারি হাসপাতাল এখন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিবিসিকে হাসপাতালের কর্মীরা জানান, বেইত লাহিয়ার ইন্দোনেশীয় হাসপাতাল ঘিরে ইসরায়েলি ট্যাংক অবস্থান নিয়েছিল এবং তারা হাসপাতালে গুলি চালাচ্ছিল। তখন ভেতরে ৫৫ জন ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন চারজন চিকিৎসক ও আটজন নার্স। বাকিরা সবাই এমন রোগী, যারা সকালবেলার হামলার পর পালাতে পারেননি।
প্রায় ৫০ মিনিট পর কর্মীরা জানান, আইডিএফ বাহিনী ওই এলাকা থেকে সরে গেছে।
আইডিএফ জানিয়েছে, তারা ইন্দোনেশীয় হাসপাতালের পাশের এলাকাসহ উত্তর গাজায় 'সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে' অভিযান চালাচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে কর্মী ও রোগীরা 'তীব্র গোলাগুলোর' মধ্যে পড়েছিলেন। ইসরায়েল ওই হাসপাতাল ঘিরে ফেলেছে, প্রবেশ বন্ধ করেছে এবং 'হাসপাতাল কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে' বলেও তারা অভিযোগ করেছে।
চিকিৎসকরা বলেন, হামলার আগে কোনো 'খালি করার আদেশ' বা সতর্কবার্তা দেয়া হয়নি এবং হাসপাতালে কোনো সামরিক লক্ষ্যবস্তুও ছিল না।
এদিকে কাতারে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চললেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, তারা 'চুক্তির জন্য সব রকম চেষ্টা' চালিয়ে যাচ্ছে। নেতানিয়াহুর বক্তব্যে বলা হয়েছে, এই চুক্তিতে 'সব জিম্মির মুক্তি, হামাস সন্ত্রাসীদের নির্বাসন এবং গাজা থেকে অস্ত্র প্রত্যাহার' অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বিবিসিকে এক হামাস কর্মকর্তা বলেন, 'ইসরায়েলের অটল অবস্থানের কারণে দোহায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।' তিনি বলেন, হামাস সব জিম্মিকে এক ধাপে মুক্তি দিতে চাইলেও 'সম্পূর্ণ ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির শর্তে' তা সম্ভব—যা ইসরায়েল মানতে চায় না।
হামাস জানিয়েছে, তারা জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি, গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তার অনুমতির প্রস্তাব দিয়েছে।
তবে হামাসের দাবি, 'ইসরায়েল অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে এক বা দুই দফায় তাদের জিম্মিদের ফেরত নিতে চায়।'
আল-আওদা প্রাইভেট হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ সালহা বলেন, ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল বন্ধ হওয়ায় তারা অক্সিজেন ও আইসিইউ সেবা পাবেন না। রাতভর বোমাবর্ষণে তাদের হাসপাতালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া ইসরায়েল খান ইউনিসে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স ও ইউরোপীয় হাসপাতালেও হামলা চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে, ইউরোপীয় হাসপাতালের নিচে হামাসের কমান্ড সেন্টার ছিল।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম বলছে, ওই হামলার লক্ষ্য ছিল হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ভাই মোহাম্মদ সিনওয়ার।
১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরায়েল হামলা শুরু করার পর হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
ইসরায়েল বলছে, 'যুদ্ধের সব লক্ষ্য অর্জনের জন্য' তারা অভিযান চালাচ্ছে। তবে ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবার জানিয়েছে, এই হামলা 'জিম্মিদের জন্য আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করছে'।
তারা বলেছে, মুক্তি পাওয়া জিম্মিরা জানিয়েছে যে সামরিক হামলার পর তাদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে, খাবার কমেছে এবং আরও কঠোরভাবে আটকে রাখা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করা হয়। এখনো ৫৮ জন ইসরায়েলি গাজায় আটক আছেন, যাদের মধ্যে ২৩ জনকে কেবল জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।