জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল কলার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে: গবেষণা

জলবায়ু সংকটের প্রভাবে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কলাচাষের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি কলাচাষের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে।
ক্রিশ্চিয়ান এইডের নতুন প্রতিবেদন 'গোয়িং ব্যানানাস: হাউ ক্লাইমেট চেঞ্জ থ্রেটেনস দ্য ওয়ার্ল্ডস ফেভারেট ফ্রুট' অনুযায়ী, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, চরম আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত পোকামাকড়ের আক্রমণে গুয়াতেমালা, কোস্টারিকা ও কলম্বিয়ার মতো কলাচাষ নির্ভর দেশগুলোতে ফলনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে এবং গ্রামীণ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
বিশ্বে কলা হলো সবচেয়ে বেশি খাওয়া ফল এবং গম, চাল ও ভুট্টার পর চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত কলার ৮০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে ভোগ করা হয়। প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ প্রতিদিনের ক্যালরির ১৫ থেকে ২৭ শতাংশ কলা থেকে গ্রহণ করেন।
বিশ্বজুড়ে সুপারমার্কেটগুলোতে যে কলা রপ্তানি হয়, তার ৮০ শতাংশই আসে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে। অথচ এই অঞ্চলটি চরম আবহাওয়া ও ধীরে ধীরে ধাবমান জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
যার ফলে, এই ফলটি আজ মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি। যার প্রভাবে শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎসই নয়, বরং এমন সব মানুষের জীবিকাও হুমকির মুখে—বৈশ্বিক উষ্ণায়নে যাদের কোনো অবদান নেই।
গুয়াতেমালার ৫৩ বছর বয়সী কলাচাষি অরেলিয়া পপ সো গবেষকদের বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের ফসল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে কোনো আয় নেই, কিছু বিক্রি করতে পারছি না। আমার বাগানের গাছগুলো একে একে মরে যাচ্ছে। আসলে যা ঘটছে, তা হলো মৃত্যু।'
বিশ্বব্যাপী রপ্তানিযোগ্য কলার বড় একটি অংশ হলো ক্যাভেনডিশ জাত, যা মূলত সুস্বাদু, টেকসই ও উচ্চফলনশীল হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়। কিন্তু এই একমাত্র জাতের ওপর নির্ভরতা এবং জেনেটিক বৈচিত্র্যের অভাব কলাকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
এই জাতের কলা ১৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো জন্মে এবং নির্দিষ্ট মাত্রার পানির প্রয়োজন হয়। অতিরিক্ত বৃষ্টি, ঝড় বা খরায় এসব গাছ সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ে পাতা ঝরে পড়ে গেলে গাছের সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ছত্রাকজাত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে, যার মধ্যে ব্ল্যাক সিগাটকা নামক ছত্রাক কলা গাছের সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। অপরদিকে, ফুসরিয়াম ট্রপিক্যাল রেস ৪ নামে একটি মাটিজনিত ছত্রাক গোটা ক্যাভেনডিশ কলার বাগান ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব রোগ মূলত স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিস্তার লাভ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
প্রতিবেদনে ধনী ও সবচেয়ে বেশি দূষণকারী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন প্রদান করে।
ক্রিশ্চিয়ান এইডের নীতিনির্ধারণ ও ক্যাম্পেইন পরিচালক ওসাই ওজিগো বলেন, 'কলা শুধু বিশ্বের প্রিয় ফল নয়, এটি লাখো মানুষের জন্য একটি প্রধান খাদ্যও। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ফলটি আজ হুমকির মুখে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেসব মানুষ এই সংকট সৃষ্টি করেনি, তাদের জীবন ও জীবিকা আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।'