জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিনের বাজার খরচ

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়া বিশ্বব্যাপী কৃষিখাতকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম—যেখানে বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
২০২৪ সাল ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এ বছর প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রথমবারের মতো ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। এতে ভেঙে যায় পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের তাপমাত্রার রেকর্ড।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘন ঘন বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ ও লবণাক্ততাসহ নানা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক কৃষক নিঃস্ব পড়ছেন। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের বাজারে দেখা দিচ্ছে অস্থিরতা; খাদ্যপণ্য কিনতে ভোক্তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি মূল্য।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরপর দুটি বন্যায় চালের উৎপাদনে ১১ লাখ টনের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে সেপ্টেম্বর মাসে চালের দাম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম
সোমবার প্রকাশিত এক গবেষণায় বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটার সেন্টারের গবেষক ম্যাক্সিমিলিয়ান কোটজ জানিয়েছেন, চরম আবহাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং এটি সমাজে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
গবেষণাটিতে ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৮টি দেশের ১৬টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চরম তাপদাহ, খরা বা অতিবৃষ্টির কারণে স্বল্পমেয়াদে খাদ্যপণ্যের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের মে মাসের তাপদাহের পর ভারতে পেঁয়াজের দাম দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৮৯ শতাংশ বেড়ে যায়। একইভাবে, ২০২২ সালের আগস্টে ভয়াবহ বন্যার পর পাকিস্তানে গ্রামীণ এলাকায় খাদ্যপণ্যের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। চীনে ২০২৪ সালের আগস্টের তাপপ্রবাহের পর জুন থেকে আগস্টের মধ্যে সবজির দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এল নিনোর প্রভাব
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলে সাগরের পৃষ্ঠদেশের পানির অস্বাভাবিক উষ্ণতার ফলে সৃষ্ট জলবায়ু প্রবণতা 'এল নিনো'র প্রভাবে ২০২৩ সালের শেষ ও ২০২৪ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে আবহাওয়ায় অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। শীতকালে বৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী শৈত্যপ্রবাহের ফলে আলু ও পেঁয়াজের উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে।
ফলে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় আলুর দাম বেড়ে যায় ১১৬ শতাংশ এবং পেঁয়াজের দাম বেড়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও কৃষি-জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মিলন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এল নিনোর প্রভাবে ২০২৪ সালে দেশের গড় তাপমাত্রা ১.৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এর ফলেই ২০২৩ সালের শেষে এবং ২০২৪ সালের শুরুতে একের পর এক শৈত্যপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরপর এপ্রিলে শুরু হয়ে মে মাস পর্যন্ত ২৬ দিন ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। সেইসঙ্গে দুটি বড় ধরনের বন্যাও দেখা দেয়।
তিনি বলেন, "এই সবকিছুই আসলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির এবং জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রতিফলন।"
কামরুজ্জামান সতর্ক করে বলেন, "ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে কৃষি খাত। অথচ এই খাতে এখনও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই, দক্ষ গবেষকেরও অভাব রয়েছে।"
তিনি বলেন, "যথাযথ বিনিয়োগ ও দক্ষ গবেষক নিয়োগ না দিলে বাংলাদেশকে সামনের দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।"
চলতি জুলাইয়ের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর ফলে গত দুই সপ্তাহে শাকসবজির দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা এবং কাঁচামরিচের দাম বেড়ে প্রায় ৩০০ টাকায় পৌঁছেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪ থেকে ১৪ জুলাইয়ের বৃষ্টিতে অন্তত ২০টি জেলায় ১৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৫২০ হেক্টর জমির শাকসবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, "টানা বৃষ্টিতে শাকসবজি ও কাঁচামরিচের ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মরিচ গাছে গোড়ায় পচন রোগ দেখা দিয়েছে। একটানা তিন-চারদিন বৃষ্টি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে। ২০২৩ সালেও টানা বৃষ্টিতে কাঁচামরিচের দাম ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।"
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন
অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আরও বলেন, "প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং অভিযোজন করতে হবে। জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। শাকসবজি ও মরিচ চাষে পলিশেড ব্যবহার করলে ক্ষতির পরিমাণ কমে।"
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী ও বিশ্বব্যাংকের ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের গ্লোবাল অবজারভার এম জাকির হোসেন খান বলেন, "ওশান তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন দ্রুত হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মৌসুম সময়মতো আসছে না, কখনও অতিবৃষ্টি, আবার যখন প্রয়োজন তখন নদীতে পানি নেই। এসবের প্রভাব সরাসরি কৃষিতে পড়ছে।"
তিনি বলেন, "মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারলেও কৃষির ক্ষতি রোধে আমরা পিছিয়ে। কৃষকদের জন্য রিয়েল টাইম তথ্যভিত্তিক পূর্বাভাস দিতে হবে। শুধু পানি বাড়বে এমন তথ্য নয়, বরং কৃষক কী করবে তা নির্দিষ্ট করে জানাতে হবে।